নদীমাতৃক দেশ আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ। প্রকৃতির বিচিত্র দানে অপরূপ রুপে সজ্জিত এই দেশ। বাংলা নামের এ জনপদকে অধিক সমৃদ্ধ করে রেখেছে হাজার হাজার খাল-বিল, হাওড়-বিল ও নদী-নালা। আর এ কারণেই বাংলা হয়েছে নদীমাতৃক বাংলাদেশ। মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের জীবনযাত্রার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে নদ-নদী। এমন এক সময় ছিল বাংলার মানুষের জীবনজীবিকার সাথে মাছ ধরা ছিল অন্যতম একটি পেশা। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছিল জেলে সম্প্রদায়। কিন্তু সময়ের আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে সব। অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে জেলে সম্প্রদায়। ভেসাল জাল পুস্তকের কথা হলেও স্থানীয় গ্রামের ভাষায় একে বেয়াল জাল বা খেয়া জাল বলে। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে এ নামেই বেশি পরিচিত। একটা সময় দেশের খালে-বিলে বর্ষা মৌসুমে ভেসাল জাল দিয়ে মাছ শিকার করতো জেলে সম্প্রদায়। প্রতিটি নদ-নদীতেই দেখা মিলত বাঁশ-সুতো দিয়ে তৈরি মাছ শিকারের বিশেষ এই যন্ত্র ভেসাল জাল। ঝাঁক বেঁধে উঠতো দেশীয় প্রজাতির নানা প্রকারের মাছ। কিন্তু বৈরি আবহাওয়া ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, অবৈধ দখল আর অপরিকল্পিত ভাবে জলাশয় ভরাটের ফলে আজ যেমন মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে দেশের খাল-বিল, নদী-নালা। ঠিক তেমনি বিলুপ্তির পথে ভেসাল জাল। কোন এক সময় ভেসাল জাল সচরাচর চোখে পড়লেও বর্তমানে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন আর চোখে পড়েনা বাংলার এক সময়ের মাছ শিকারের জনপ্রিয় এই ভেসাল। নদীর অস্তিত্ব সংকটের সাথে সাথে আজ দেশীয় প্রজাতির মাছ ও মাছ ধরার বিশেষ এই পদ্ধতিও হারিয়ে যাচ্ছে। নদীর পাড়ের চিনু মিয়া জানায়, এমন এক সময় ছিল সারা রাত ধরে করতোয়া নদীতে ভেসাল দিয়ে মাছ ধরতাম। প্রতি রাতে যে মাছ পেতাম তা দিয়েই চলত আমাদের সংসার। এখন নদীতে পানি থাকে না। ২-৩ মাস বর্ষা মৌসুমে একটু পানি থাকলেও আগের মতো আর মাছ পাওয়া যায় না।
নদীতে যদি পানিই না থাকে তাহলে ভেসাল জাল থাকবে কি করে! পানি নেই, মাছ নেই তাই ভেসাল জালও নেই। নুরুইল বিলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার খালে বেশ কয়েকটা ভেসাল রয়েছে। কথা হয় ভেসালের মালিক আমিরুল হোসেনের সাথে। তিনি জানায়, বর্ষা মৌসুমে একটু পানি থাকে। তখন ভেসাল দেই আমরা। পানি শুকিয়ে গেলেই ভেসাল খুলে বাড়ি নিয়ে যাই। একটি ভেসাল দিতে যে খরচ সে খরচও এখন উঠতে চায় না। বিলে এখন মাছ নেই বলে ভেসালে মাছ শিকার জনপ্রিয় পদ্ধতি হারিয়ে যাচ্ছে। এটি গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্যবহন করে।
পূর্বে গ্রামাঞ্চলের নদী-নালা, খাল-বিলে প্রচুর ভেসাল দেখা গেলেও, বাস্তবতা এখন ভিন্ন। বৈরি আবহাওয়া ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, অবৈধ দখল আর অপরিকল্পিত ভাবে জলাশয় ভরাটের ফলে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে নদী। যার কারণে ভেসালও এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। বয়োবৃদ্ধ আজবালী সরদার বলেন, গ্রামবাংলার পথঘাট দিয়ে পূর্বে হেঁটে যেতে চোখে পড়ত অনেক ভেসাল জাল। কিন্তু এখন আর তেমন দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ নদ-নদী খাল বিল ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠার ফলে অনেক দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে। আর খাল বিলে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় মাছ ধরার বিশেষ ফাঁদ ‘ভেসাল’ জালও এখন বিলুপ্তির পথে।