রংপুর অঞ্চলে হিমেল হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতের তীব্রতা। উচ্চবিত্তরা ঠান্ডা থেকে বাঁচতে গরম কাপড় দিয়ে শীত নিবারণ করতে পারলেও দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের হতদরিদ্র মানুষ। কেউ আগুন জ্বালিয়ে শীত তাড়ানোর চেষ্টা করছেন। আবার কেউ ছুটছেন পুরোনো কাপড়ের দোকানে। কিন্তু এ বছর ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরোনো কাপড়ের দামও বেড়ে গেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। গত বছরের তুলনায় এবার প্রতিটি গরম পোশাকের দাম ১০০ থেকে ২০০ টাকা বেশি। রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া, ধরলা নদীরবেষ্টিত ৬৬৮টি চর রয়েছে। এ সব চরে আশ্রিতরা তীব্র শীতে দুর্ভোগে পড়েছেন। তাদের সরকারি, বেসরকারিভাবে যতসামান্য শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। রংপুর বিভাগের আট জেলায় হাড় কাঁপানো শীত নেমেছে। তাপমাত্রা নেমে এসেছে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সেই সঙ্গে হিমেল বাতাস শীতের তীব্রতা বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। জনজীবন একেবারে অচল হয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড শীতে জনজীবন জবুথবু অবস্থা।
রংপুর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টায় রংপুর বিভাগের পঞ্চগড় জেলায় তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপরেই রয়েছে ঠাকুরগাঁও য়ে ৯ ডিগ্রি, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি, রংপুরে ৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি, নীলফামারীর সৈয়দপুরে ১০ দশমিক ১ ডিগ্রি, দিনাজপুরে ১০ দশমিক ১ ডিগ্রি, নীলফামারীর ডিমলায় ১১ ডিগ্রি, লালমনিরহাটে ১০ ডিগ্রি ও গাইবান্ধায় ১০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মৃদু শৈত্যপ্রবাহ চলছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা আর সর্ব্বোচ্চ তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য অনেক কমে যাওয়ায় এ অবস্থা হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে ঘন কুয়াশা। গত তিন দিন ধরে সূর্যের দেখা পাচ্ছে না এই অঞ্চলের মানুষ।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান শু জানান, চলতি সপ্তাহজুড়ে শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। সেই সঙ্গে তাপমাত্রা আরো কমে যেতে পারে। পুরো মাসজুড়ে মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। প্রতি বছর নিম্ন আয়ের মানুষদেরকে বিভিন্ন সংস্থা এবং ব্যক্তির উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয় যা খুবই নগন্য। রংপুরের স্টেশন মার্কেট, জামাল মার্কেট, আলমনগর কেজি মার্কেট, সুরভি উদ্যান ফুটপাত মার্কেটের পুরোনো পোশাকের দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের ভিড়। ব্যবসায়ীরা জানান, পুরোনো কাপড় হলেও এ সব কাপড়ের মান ভালো। বিদেশি কাপড় তুলনামূলক সন্তাতে পাওয়ায় এখন ধনী-গরীব সবাই কিনছেন। তবে নিম্ন আয়ের মানুষজনই এ সব পুরোনো কাপড় বেশি কিনে থাকেন।
দিনমজুর আব্দুল জব্বার বলেন, ‘হামার তো আর সাধ্য নাই বড় মার্কেট থাকি কাপড় কিনমো। ঠান্ডা আসলে এখান থাকি কাপড় কিনি। বাড়ির সবাইকে কিনি দেই।’ তিনি জানান, এ দোকানগুলোতে কম দামে কাপড় পাওয়া যায় তাই তিনি কেনেন। তবে এ বছর বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে পুরোনো কাপড়। মোছলেমা আক্তার নামে এক ক্রেতা বলেন, প্রথমবারের মতো পুরাতন কাপড়ের দোকানে এসেছি। এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর কাপড়ও রয়েছে। সুপার মার্কেটে যেগুলো নতুন কিনলে লাগতো ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা এখানে সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে ৫০০-৬০০ টাকার মধ্যে। মাহিগঞ্জ থেকে পুরাতন পোশাক কিনতে আসা মজনু মিয়া বলেন, শীত আসলে কেজি মার্কেট থেকে কাপড় কিনি। বিভিন্ন দোকানগুলোতে ঘুরছি। যে দোকানে কম দাম পাবো সেখান থেকেই কিনবো। গত বছর ২৫০ টাকাতেই ভালো কাপড় কিনছিলাম কিন্তু এ বছর ৪০০ টাকাতেও পাচ্ছি না। আলমনগর কেজি মার্কেটের ব্যবসায়ী মিঠু বলেন, আমার দোকানে সব ধরনের কাপড় পাওয়া যায়। মানুষ চাহিদা মতো তাদের কাপড় কেনে। এগুলো পুরাতন কাপড়। অনেক গরীব মানুষ আসে কাপড় কিনতে আমরা এগুলো অনেক কম দামে দিয়ে দেই। ইয়াসিন নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার প্রতিটি গরম পোশাকের দাম ১০০ থেকে ২০০ টাকা বেশি। গত বছর যে সোয়েটার বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়, একই সোয়েটার এবার বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায়। একই ভাবে জ্যাকেট, ট্রাউজার, কম্বলসহ অন্যান্য গরম পোশাকের দামও বেশি। শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন প্রতিদিন ভালোই বিক্রি হচ্ছে। আলমনগর কেজি মার্কেটের সভাপতি আবিদ হোসেন বলেন, আমাদের এই পুরাতন কাপড়ের মার্কেটে ২০০ দোকান রয়েছে। এ সব দোকানের অধিকাংশ কাপড় বিদেশ থেকে আমদানি করা। এগুলো মূলত জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান ও চীন থেকে জাহাজে করে আসে।
এরপর চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এ বছর কাপড় কিনতে বেশি দাম লাগছে তাই গতবারের তুলনায় কাপড়ের দাম একটু বেশি। তবে শীত বেশি থাকায় বিক্রিও ভালো হচ্ছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে রংপুর বিভাগে তাপমাত্রা উঠানামা করছে ৭ থেকে ১২ ডিগ্রিতে। অধিকাংশ দিনই সূর্যের দেখা মিলছে না। ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। এদিকে শীতজনিত নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, পেটব্যথা, জন্ডিস, সর্দি-জ্বরে ভুগছে শিশু ও বৃদ্ধরা। এ কারণে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) উত্তরাঞ্চলের বহু মানুষ প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসছেন।
রমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণে চেষ্টা করতে গিয়ে অনেকেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। শীতের সময়টাতে এমন রোগব্যাধী বাড়ে। আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল জানিয়েছেন রংপুর জেলার ৮ উপজেলার তিনিটি পেীরসভায় এবং সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৫৪ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। শীত পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলায় সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগে শীতার্তদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।