শেরপুরের নকলা উপজেলায় সচেতনতার অভাবে জমিতে ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন কৃষক। শীতকালীন স্থানীয় শাক-সবজি উৎপাদনে শীর্ষে থাকা উপজেলার চন্দ্রকোনা, বানেশ্বরদী, পাঠাকাটা ও চরঅষ্টধর ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আলুসহ বিভিন্ন ফসলের রোগ-বালাই ও পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কৃষকরা ও কৃষি শ্রমিকরা জমিতে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক (বিষ) স্প্রে করছেন।
সস্প্রতি চন্দ্রকোনা ও বানেশ্বরদীতে গিয়ে দেখা গেছে, কৃষকরা ভরদুপুরে তাদের আলুর খেতেসহ বিভিন্ন ফসলের জমিতে সম্পূর্ণ অসেচতন ভাবে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। কারো নাকে-মুখে কোনো কাপড় বা মাস্ক নেই। অনেক কৃষক টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে জমিতে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। কেউবা আবার ধানের জমিতে সারের সঙ্গে আগাছানাশক মিশিয়ে হাতমোজা ছাড়াই হাত দিয়ে ছিটাচ্ছেন। কীটনাশকের প্যাকেট বা বোতলের গায়ে স্পষ্ট অক্ষরে ‘বিষ’ লেখা থাকলেও সচেতনতার অভাবে তা আমলে নিচ্ছেন না।
নিয়মনীতি না মেনেই এলাকার কৃষকরা যে যার মতো জমিতে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। ফলে সঠিক পরামর্শের অভাবে নিরাপদ পদ্ধতিতে কীটনাশক ব্যবহার না করায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন কৃষকরা। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ‘কীটনাশক ছিটানোর সঠিক কোনো পদ্ধতি সম্পর্কে তারা জানেননা। তাদের নাকি আজপর্যন্ত কেউ কোন প্রকার পরামর্শও দেয়নি। কেউ কেউ বলেন, ‘কীটনাশক ছিটানোর সময় খুবই দুর্গন্ধ ছড়ায়।
বিষ স্প্রে করার পর মাঝে মধ্যে মাথা ঘোরে বা ব্যথা করে, বিভিন্ন ধরনের অসুবিধা দেখা দেয়। তখন স্থানীয় পল্লি চিকিৎসকের পরামর্শ ও চিকিৎসা নেই। তবে আজ পর্যন্ত মারাত্মক কোন সমস্যার সম্মুখিন হইনি। উপজেলার চন্দ্রকোনা এলাকার কৃষক রহমত আলী নিজের মতো করে বলেন ‘আঙরে খেতে কোনো পোকা মাকড় ধরলে খেতে বিষ দেওন নাগে। আমরা সবাই সারাজীবন এভাবেই বিষ দেই। তাতে আইজ পর্যন্ত কিছু অসুখ বিষুখ অয়নাই। আঙরে বাপ-দাদারাওতো এভাবেই বিষ দিতো। তাগরওতো কোনদিন কিছু অয়নাই। আমার মতো মুর্খ মানুষদের সঙ্গে আল্লাহর রহমত আছে। আঙরে বাপ-দাদারা যেভাবে বিষ দিতো, আমরাও অহনা ওই ভাবেই বিষ দেই। আগে মুরুব্বিগরে কিছু অয়নাই, অহন আঙগরও কিছু অয়তোনা!
ভূরদী খন্দকার পাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শিক্ষিত কৃষক মো. ছায়েদুল হক বলেন-আমাদের সংগঠনের সদস্য সংখ্যা নারী-পুরুষ মিলে ৭০-৭৫ জন এবং সবাই কৃষক। আমরা প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ শুক্রবার সব সদস্যসহ আশেপাশ এলাকার কৃষক-কৃষাণীদের নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা সভা করি।
সেখানে কার কি সমস্যা, তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। নিজেদের মধ্যে কেউ সঠিক পরামর্শ দিতে পারলে ভালো, নতুবা কৃষি বিভাগের হ্যাল্প লাইন মোবাইলে ফোন দিয়ে পরামর্শ নিয়ে সমস্যা সমাধান করি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এবং বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষি বিভাগের হ্যাল্প লাইন মোবাইলে নিয়মিত পামর্শ নিয়ে ভূরদী খন্দকার পাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিটি সদস্য আজ কৃষি ডাক্তারে পরিণত হয়েছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা তাদের ফসলের সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের সংগঠনের সদস্যদের কাছে পরামর্শ নিয়ে উপকৃত হচ্ছেন।’ তাছাড়া প্রতি মাসে অন্তত একবার কৃষক-কৃষাণীদের নিয়ে সচেতনতা মূলক সভা করেন বলেও তিনি জানান।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘কীটনাশক ছিটানোর সময় নিরাপদ পোশাক ব্যবহার না করলে নাক ও মুখ দিয়ে বিষ শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে বিষক্রিয়া হতে পারে। এতে মৃত্যুর সম্ভাবনাও রয়েছে বলে তিনি জানান। তাই জমিতে কীটনাশক ছিটানোর সময় অবশ্যই নাক-মুখে মাস্ক ও হাতে মোজা বা গ্লাফস ব্যবহার করা জরুরি।’ এ বিষয়ে কৃষকের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। সচেতন মহল বলছেন, কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রচার করতে হবে মাত্রারিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করা শাক-সবজিসহ সব কৃষিপণ্য মানবদেহের জন্য জন্য ক্ষতিকর। ফসলে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান তারা।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী জানান, তারা কৃষককে কীটনাশক প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে বরাবরই পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কীটনাশকের পরিবর্তে আলোক ফাঁদ, ফেরোমন ফাঁদ ও হলুদ ফাঁদসহ বিভিন্ন সমন্বতি বালাই ব্যবস্থাপনা ব্যবহারে কৃষকদের নিয়মিত উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। যেসব কৃষক অপেক্ষাকৃত কম বুঝেন, তারা জৈব সারের চেয়ে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বেশি ব্যবহার করেন। তবে নিরাপদ কীটনাশক ব্যবহারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হয় এবং হচ্ছে।
এছাড়া জৈব সার ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা। তারা সবসময় এ বিষয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে আসছেন। নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষক সংগঠনের নেতারা ও সচেতন কৃষকদের সাথে নিয়ে নিরলস কাজ করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসয়নিক সার ব্যবহার বন্ধে কৃষি বিভাগ থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে কৃষকদেরও নিজে থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণসহ আরো সচেতন হবে। শুধুমাত্র কৃষি বিভাগের পক্ষে ক্ষতিকর কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।