বগুড়া শহরের অলিগলিতে কিংবা রেললাইনের পাশ দিয়ে প্রতিদিন দেখা যায় অসহায় নারীদের, যারা শাক-কচু বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। জীবনযুদ্ধের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি এই নারীদের কেউ বিধবা, আবার কেউ বৃদ্ধ বয়সে সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন।
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার আগুনিয়াতাইড় গ্রামের বাসিন্দা বিউটি বেগমের জীবনও এর ব্যতিক্রম নয়। ১৬-১৮ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় জীবনের কঠিন লড়াই। শুরুতে মানুষের বাড়িতে কাজ করলেও শারীরিক দুর্বলতা ও হাত ভেঙে যাওয়ায় সে কাজও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি শুরু করেন শাক-কচু বিক্রি।
প্রতিদিন ভোরে ট্রেনে বা সিএনজিতে শহরে আসেন তিনি। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে কচু সংগ্রহ করেন এবং তা বিক্রি করে সামান্য কিছু আয় করেন। দিনে গড়ে ২০০-৩০০ টাকা রোজগার হলেও কখনও শীতের মৌসুমে কচুর চাহিদা কম থাকায় খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। বিউটি বেগম জানান, জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য অল্প কিছু জমি কেনার চেষ্টা করলেও এখনও দলিল করতে পারেননি। বিউটি বেগমের মতো আরো অনেক নারীর জীবনের গল্পও একই রকম। সোনাতলার লোহাগাড়া গ্রামের মালেকা বেওয়া ৭৫ বছর বয়সেও শাক-কচু বিক্রি করে জীবনধারণ করছেন। বয়সের ভারে ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না, চোখে ছানি পড়ায় দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে। রাত কাটে রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে।
গাবতলীর হামিদপুর গ্রামের হাছনা বেগম ১১ বছর আগে স্বামী হারিয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে শহরে এসে বসতি গড়েন। সন্তানদের বড় করে তোলার পরেও ঠাঁই মেলেনি ছেলের সংসারে। বেঁচে থাকার জন্য এখনও প্রতিদিন গ্রাম থেকে শাক সংগ্রহ করে শহরে বিক্রি করেন। সুজাইতপুর গ্রামের মেরিনা বেওয়ার স্বামী মারা গেছেন ৯ বছর আগে। ছেলেদের জন্য এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে রিকশা কিনে দিয়েছিলেন, কিন্তু ছেলেরা বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ায় বৃদ্ধা মায়ের জায়গা হয়েছে রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। শাক বিক্রির টাকায় সংসার চালানোর পাশাপাশি সপ্তাহে দুইদিন এনজিওর কিস্তি পরিশোধ করতে হয় তাকে।
এ সব নারীদের জীবনের একমাত্র বাস্তবতা হলো প্রতিদিন শাক-কচু বিক্রি করা, যাতে অন্তত একবেলা খেতে পারেন। কচু খাওয়ার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা অনেক। যেমন: কোলন ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো, ফাইবার ও থায়ামিন সরবরাহ করা। অথচ যারা এ সব পুষ্টিকর খাদ্য আমাদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন, তাদের জীবন চলছে দারিদ্র্যের কষাঘাতে। অবহেলিত এই নারীদের পুনর্বাসন ও আত্মনির্ভরশীলতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ। তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কার্যকর করা, বিধবা ও বয়স্ক ভাতার আওতায় আনা, এবং বিকল্প আয়ের উৎস সৃষ্টি করাই হতে পারে টেকসই সমাধান।