গাইবান্ধা শহরের ঘাঘট পারে নতুন ব্রিজ এলাকায় পরিবার সহ বসবাস করেন ফরিদা পারভীন। রুচিশীল ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রমী দেশিয় পণ্যের প্রতিষ্ঠান ‘স্বপ্ন আঁকা’ পরিশ্রম ও সুচিন্তিত উদ্যোগ ঘুরিয়ে দিয়েছে ফরিদার ভাগ্যের চাবি। তার স্বপ্নের সারথি অন্য নারীদেরও স্বপ্নের রঙে রাঙিয়েছেন তিনি। ফরিদার এ স্বপ্নযাত্রায় সদা সর্বদা পাশে থেকে ফরিদার স্বামী মুহম্মদ নাজমুল হুদা উদার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফরিদা সংসার সামলানোর পাশাপাশি এখন একাধারে একজন উদ্যোক্তা, প্রশিক্ষক ও উৎপাদক হিসেবে কাজ করছেন। শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, বিছানার চাদর, পর্দা, কুশন-কভার ইত্যাদি তার শখের ক্যানভাস দেশীয় কাপরে রংতুলির আচরে মনোমুগ্ধকর করে ফুটিয়ে তুলেন। জীবিকার খোঁজেই গড়ে তোলেন দেশি পণ্যে রঙের ছোঁয়ার উদ্যোগ ‘স্বপ্ন আঁকা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ব্লক, বাটিক, টাইডাই, হ্যান্ড পেইন্ট-যা করেছেন সব কিছুতেই সুনাম কুড়িয়েছেন। শুরুতে কাছের মানুষদের মাঝেই শুধু ছিল পরিচিতি, এখন ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে কাজের পরিসর বেড়েছে, এসেছে সফলতাও। ধীরে ধীরে নাম লিখিয়েছেন সফল উদ্যোক্তার তালিকায়। প্রতিকূল পথ পাড়িয়ে রঙিন স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলেছেন অদম্য এই নারী ফরিদা পারভীন। স্বপ্নবাজ এই নারীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শান্তিরাম ইউনিয়নের শোভাগঞ্জ গ্রামে। সেখান থেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সম্প্রতি স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। তিন ভাই আর এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। পরিবারের সম্মতিতে নিজের পছন্দের মানুষের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন ২০১৬ সালে। পরের বছর ২০১৭ সালে নাজমুল-ফরিদার কোলজুড়ে আসে একমাত্র সন্তান আবদুল্লাহ আল ফিহাদ। প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে উঠলেও, সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ছিল ফরিদার উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন। ছোটবেলা থেকেই তার আঁকার শখ। ২০১৯-এ শখেরবশে ইউটিউব দেখে শিখে নেন হ্যান্ড পেইন্টের কলাকৌশল। নিজের জমানো টাকা দিয়ে মাত্র ৩ গজ কাপড়, সামান্য কিছু রং আর হ্যান্ড পেইন্টের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে নিজের জামা নিজেই ডিজাইন করেন। সেই সময় ধীরে ধীরে তা অনেকের নজরে আসে। একসময় আত্মীয়-স্বজনের গণ্ডি ছাড়িয়ে ক্রেতার সংখ্যা ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে। সেই থেকে যাত্রা শুরু। স্বামীর কাছ থেক হাওলাত হিসেবে ৩ হাজার টাকা নিয়ে স্বপ্নময়ী এই নারীর প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০২০ সালে। যেহেতু রং-তুলিতে কল্পনার রঙিন নকশা ফুটিয়ে তোলেন নিজের আঁকা, তাই প্রতিষ্ঠানের নাম দেন ‘স্বপ্ন আঁকা’। প্রথম দিকে নিজের হাতে সব করলেও কাজের চাপ বাড়ায় একসময় দুজন কর্মী নেন ফরিদা। ২০২০ সালের এপ্রিলে করোনা কালের শুরুতেই ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির কাজ হারিয়ে তার সঙ্গে যোগ দেন স্বামী মুহম্মদ নাজমুল হুদা। বর্তমান ফরিদার স্বপ্ন আঁকায় স্থায়ীভাবে কাজ করেন ১৫ জন নারী কর্মী। এছাড়া অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজে আছেন আরও অর্ধশতাধিক নারী। এখানে প্রতিদিন অন্তত ১০টি শাড়িতে হ্যান্ড পেইন্ট, ব্লক, বাটিক, টাই সহ দেড় শতাধিক পোশাক তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। স্বপ্ন আঁকার প্রতিদিনের গড় বিক্রি ২০-২৫ হাজার টাকা। গাইবান্ধার বাইরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাইকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে খুচরা বিক্রি হয় তার পণ্য। দেশের বাইরেও যায় স্বপ্ন আঁকার পণ্য। ইতোমধ্যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালিদের কাছে পণ্য বিক্রি করেছেন ফরিদা।
ফরিদা বলেন, ২০২০ সালে আমি ‘স্বপ্ন আঁকা’ নামে ফেসবুক পেজ খুলি। বাঙালি ঐতিহ্য-কৃষ্টির অনুপ্রেরণায় দেশি তাঁতের কাপড়ে রং-তুলির হ্যান্ড পেইন্টের পাশাপাশি ব্লক, বাটিক, টাই নিয়ে কাজ শুরু করি। সে সময় কাজের পরিমাণ কম হলেও রুচিশীল পোশাক তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছি। ক্রেতার শখ, সাধ্য আর আস্থায় থাকতে চেয়েছি সবসময়। চেষ্টা করেছি দেশি কাপড়ে দেশীয় ডিজাইন নিয়ে কাজ করার। তিনি বলেন, আমি চাই দেশি পণ্যের মজবুত ভিত গড়তে। পাশাপাশি আমার চাওয়া এই উদ্যোগ সম্পর্কে সবাই জানুক। সম্প্রতি গাইবান্ধায় হ্যান্ডপেইন্টে দক্ষজন বল তৈরির উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয় নারীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ শুরু করেছি। আমি চাই, সব প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে দিয়ে মেয়েরা আমার মতো নিজের পায়ে দাঁড়াক। এই খাতে সুবিধা অনেক, তবে পথটা অমসৃণ। অনেক বাধার মধ্যে মূলধন, পর্যাপ্ত জায়গা, আর পারিপার্শ্বিক বাধা তো আছেই। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণসহ বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। তা হলে নারীরা ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও উৎসাহী হবেন। শুরুতে কাছের মানুষদের মাঝেই শুধু ছিল পরিচিতি, এখন ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে কাজের পরিসর বেড়েছে, এসেছে সফলতাও। ধীরে ধীরে নাম লিখিয়েছেন সফল উদ্যোক্তার তালিকায়। প্রতিকূল পথ মাড়িয়ে রঙিন স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলেছেন অদম্য এই নারী ফরিদা পারভীন।