শরীয়তপুরে এবার পেঁয়াজের ফলন ভালো হলেও ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় হাসি নেই কৃষকের মুখে। বাজারমূল্য উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় কম হওয়ায় অনেক কৃষককেই লোকসানের ঘানি টানতে হচ্ছে। ঋণের টাকায় পেঁয়াজ চাষিদের লোকসানের মাত্রা আরো বেশি। তবে আগাম আবাদ ও উত্তোলনকারীরা সন্তোষজনক দাম পেয়ে লাভবান হয়েছেন। কৃষকের হিসেব মতে এবার রোপণ মৌসুমে বীজের অধিক দাম থাকায় সব মিলিয়ে বিঘা প্রতি উৎপাদন খরচ লাখ টাকার ওপরে। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আগাম আবাদকারী কৃষক লাভবান হয়েছেন। মধ্য মৌসুমে উত্তোলনকারীরা চালান তুলতে পারলেও বাকিরা বিঘায় লোকসা গুণছেন ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। পেঁয়াজের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার জন্য অনেক কৃষকই ভরা মৌসুমে আমদানীকে দুষছেন। তাই পেঁয়াজ আবাদ অব্যাহত রাখতে মৌসুমকে মাথায় রেখে আমদানির দাবি কৃষকদের। এছাড়াও কৃষকদের আবাদ মৌসুমে সার ও বীজের সহজ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার দাবিও জানিয়েছেন কৃষকরা।
শরীয়তপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ি জেলায় এবার পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ১২০ হেক্টর থাকলেও আবাদ হয়েছে ৪ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে মুড়িকাটা ৩ হাজার ৮৬০ হেক্টর ও হালি পেয়াজ ৪২০ হেক্টরে। এরই মধ্যে জেলার মুড়িকাটা পেঁয়াজ উত্তোলন স্মপন্ন হলেও হালি পেঁয়াজ উত্তোলন বাকি মাত্র ১০০ হেক্টর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়েছে। মুড়িকাটা পেঁয়াজের ফলন হয়েছে হেক্টর প্রতি ১০ থেকে ১৩.৫ টন ও হালি পেঁয়াজ ৮ থেকে ১০টন পর্যন্ত। জেলার সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় জাজিরা উপজেলার বিকেনগর, পশ্চিম নাও ডোবা, পূর্ব নাওডোবা, সেনেরেচর, বড় কান্দি, বড় গোপালপুর, মূলনা, জাজিরা, জয়নগর ও পালের চর ইউনিয়নে। এছাড়াও উপজেলার বিলাসপুর, কুন্ডেরচর ইউনিয়নে তুলনামূলক কম আবাদ হয়। নড়িয়া উপজেলার রাজনগর, মোক্তারের চর, নশাসন, জপসা ইউনিয়নে বেশি আবাদ হয়। সদর উপজেলার চন্দ্রপুর, চিকন্দী, শৌলপাড়া, ডোমসার ও বিনোদপুর ইউনিয়নে, ডামুড্যা উপজেলার কনেশ্বর, ইসলামপুর, ধানকাঠি, সিধলকুড়া ও পূর্ব ডামুড্যা ইউনিয়নে, গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়া, সামন্তসার, ইদিলপুর, নলমুরি, কুচাইপট্টি, ও গোসাইরহাট ইউনিয়নে এবং ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছয়গাঁও, রামভদ্রপুর, ডিএম খালি’ চরভাগা, তারাবুনিয়া ও সখিপুর ইউনিয়নে পেঁয়াজের আবাদ হয়।
জাজিরা উপজেলার পালেরচর ইউনিয়নের দড়িকান্দি গ্রামের কৃষক ফারুক আকন বলেন, রোপনের সময় প্রতি কেজি বীজ কিনতে হয়েছে ২৭৫ টাকা থেকে তিনশ’ টাকায়। এছাড়াও জমি চাষ, লেবার, সার ও সেচ খরচও বেশি হয়েছে। ফলে বিঘা প্রতি লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। এবার আমি ৩ বিঘা জমিতে ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা খরচ করে আগাম মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ করেছি। আগাম ফলন পাওয়ায় এবার আমি তিন বিঘা জমির পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। আলহামদুলিল্লাহ আমার বেশ লাভ হয়েছে। একই উপজেলার বিকেনগর ইউনিয়নের হাওলাদারকান্দি গ্রামের কৃষক চানমিয়া বেপারী বলেন, আমার জমি একটু নিচু হওয়ায় পেঁয়াজ আবাদে বিলম্ব হয়েছে। তাই আগাম উত্তোলনকারীদের তুলনায় অর্ধেকেরও কম বাজার দর পাচ্ছি। বর্তমানে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ৮৪০ টাকা মণ ও হালি পেঁয়াজ এক হাজার ২৫০ টাকা মণ দরে বিক্রি করতে পারছি। ফলে মুড়িকাটা পেঁয়াজে আমার বিঘাপ্রতি গড়ে ৩০ হাজার টাকা ও হালি পেঁয়াজে ৪০ হাজার টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে। এমনিতেই লোন নিয়ে কৃষি কাজ করায় আমাদের লাভের অংশ কমে যায়। তার পর যদি ফসল আবাদ করে লোকসান গুণতে হয় তাহলে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাব। তাই যখন আমাদের খেতের পেঁয়াজ উঠে তখন যদি সরকার পরিকল্পনা করে আমদানি করে তাহলে আমরা বাঁচতে পারব।
জেলার কৃষি বান্ধব মিরাশার চাষি বাজারের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও পাইকার আব্দুল জলিল মাদবর বলেন, এবার আগাম পেঁয়াজ উত্তোলনকারী কৃষক ভালো বাজারমূল্য পেলেও বর্তমানে কৃষকরা মোটেও লাভের মুখ দেখছেন না। প্রথম পর্যায়ে মুড়িকাটা পেঁয়াজের দাম ছিল মণ প্রতি ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা। ধীরে ধীরে দাম কমতে কমতে একই পেঁয়াজের দাম পাচ্ছেন ৭২০ টাকা থেকে ৮৮০ টাকা। বাজারে এখন হালি পেঁয়াজ আসতে শুরু করেছে। হালি পেঁয়াজের দাম পাচ্ছেন কৃষক মণ প্রতি ১ হাজার ২০০টাকা থেকে ১ হাজার ২৮০ টাকা। তাও উৎপাদন খরচের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
শরীয়তপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোস্তফা কামাল হোসেন বলেন, এ মৌসুমে জেলার কৃষক পেঁয়াজের ভালো ফলন পেয়েছেন। জেলায় মুড়িকাটা ও হালি পেঁয়াজের আবাদ হয়ে থাকে। মুড়িকাটা পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে না পারায় উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গেই কৃষককে বিক্রি করতে হয় বলে বাজার ব্যবস্থার ফলে তারা প্রকৃত মূল্যটা পান না। তাই আমরা কৃষকদেরকে সংরক্ষণযোগ্য হালি পেঁয়াজ আবাদে উদ্বুদ্ধ করছি। যাতে করে মৌসুমের শেষে বাজার স্থিতিশীল হলে পেঁয়াজে কৃষক লাভবান হতে পারেন। জেলার ৬ উপজেলায় এবার পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ১২০ হেক্টর থাকলেও আবাদ হয়েছে ৪ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে জাজিরা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৯৭৫ হেক্টর। নড়িয়া উপজেলায় ৬১০, ভেদরগঞ্জ উপজেলায় ২২০, গোসাইরহাট উপজেলায় ১৯৬, সদর উপজেলায় ১৮৫ ও ডামুড্যা উপজেলায় ৯৪ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। জেলার বর্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৯ হাজার ৯২৪ টন হলেও এবছর ৫৫ হাজার ৪২৬ টন উৎপাদন হবে বলে আমরা আশা করছি। এরই মধ্যে ৯৮ শতাংশ পেঁয়াজের ফলন কৃষক ঘরে তুলেছেন।