কুষ্টিয়াসহ দেশের সরকারি অফিস, আদালতপাড়া, উপজেলা সদরের কোর্ট আর সাব ও জেলা রেজিস্টি অফিস চত্বর ঘিরে নানা প্রয়োজন মেটাতেই ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠে টাইপ রাইটারের ব্যবসা। সরকারি অফিস এলাকায় টাইপিস্টদের বাজার বসলেও হাল আমলে তাদের ভাটার টান পড়েছে সে ব্যবসায়। টাইপ রাইটার মেশিন আবিষ্কারের কথা জানা গেলেও কেউই বলতে পারেনি ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল এ ব্যবসা। মামলা-মোকদ্দমা, জায়গা-জমি রেজিষ্ট্রিসহ নানা কাজে প্রতিদিন কুষ্টিয়ার এসব সরকারি অফিসে আসছেন হাজার হাজার মানুষ। জরুরি প্রয়োজনেই তাদের টাইপ বা কম্পোজ করতে হয়। আর এ চাহিদা মেটাতেই দরকার পড়ে টাইপিস্ট বা মুদ্রাক্ষরিকদের। তবে বিজ্ঞানের নব আবিষ্কার কম্পিউটার ব্যবসার প্রসারের ফলে মানুষ ঝুঁকে পড়েছে সেদিকে। কিন্তু বিদ্যুতের লোডশেডিং-এর কারনে অনেক গ্রাহক বাধ্য হয়েই আসছেন টাইপিস্টদের কাছে।
যুগ যুগ ধরে নানা প্রয়োজন মেটাতেই সরকারি অফিস এলাকায় টাইপিষ্টদের বাজার বসলেও হাল আমলে ভাটার টান পড়েছে সে ব্যবসায়। পেটের তাগিদেই সেকেলে টাইপরাইটার নিয়ে এখনও বসতে হয় তাদের। মানুষের রুচি এবং চাহিদার বড় রকমের পরিবর্তন ঘটায় এখন আর মুদ্রাক্ষরিকদের তেমন কদর নেই। নেই আগের মতো আয়- রোজগারও। জেলা বারের পুরোনো ভবনের বারান্দায় ও আইনজীবী ভবনের উত্তর দিকে টিনের ছাপরা ঘরে বসে দীর্ঘ দুই দশক ধরে মুদ্রাক্ষরিকের কাজ করছেন আব্দুল হান্নান ও মিঠু। তারা জানান, কোর্ট ভবনকে কেন্দ্র করে এখানকার প্রায় সব বারান্দাতেই বসেন তারা। কিন্তু সেখান থেকেও তাদের নাকি উচ্ছেদ করা হবে। একেতো আগের মতো আয়-রোজগার নেই তার উপর বসবার স্থানটুকুও না থাকলে তারা কোথায় যাবেন ? তিনি আরো বলেন, জরুরি প্রয়োজন আর বিদ্যুৎ না থাকলেই এখন তাদের দ্বারস্থ হয় মানুষ। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন মানুষ শুধু তাদের কাছেই আসতো। এখন দিন বদলে গেছে। এভাবেই চলছে টাইপিস্টদের জীবন ও জীবিকা।
সজিব আহম্মেদ নামের এক গ্রাহক জানান, এক পাতা বাংলা বা ইংরেজি কম্পিউটার কম্পোজ করাতে ১৫ থেকে ২০ টাকা লাগে। বাইরে হয়তো আরো কমে সম্ভব। কিন্তু প্রয়োজন যেহেতু এখানে, তাই ২/৪ টাকা বেশি হলেও এখানে করাচ্ছেন। তার মতে, প্রায়ই এখন কম্পিউটারে টাইপ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকাতেই জরুরিভিত্তিতে তিনি এখানে এসেছেন। দেখা গেছে, কুষ্টিয়া ডিসি কোর্টের মূল ভবনের উত্তর পাশে এবং কোর্ট বিল্ডিং সংলগ্ন স্থানে কম্পিউটারে কম্পোজ, ফটোকপিসহ কোনো কিছুর কমতি নেই। বিদ্যুৎ থাকা সাপেক্ষে প্রায় সব সময়ই ব্যস্ত থাকছে কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপিয়ার মেশিনগুলো। জেলা আইনজীবী ভবনের উত্তর বারান্দাতে দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে মুদ্রাক্ষরিকের কাজ করছেন ষাটোর্দ্ধ প্রবীন আ. সালাম। তিনি জানান, বর্তমানে মুদ্রাক্ষরিকরা ভালো নেই। আগে যেখানে একদিনের কাজ দু’দিনেও শেষ করা যেতো না এখন সেখানে দিনের বেশির ভাগ সময়ই বসে কাটাতে হচ্ছে। তাই আগের মতো আয়-রোজগারও নেই। বেশির ভাগ কাজই হচ্ছে কম্পিউটারে। বাড়তি কপির জন্য ফটোস্ট্যাট।
আদালতপাড়াসহ শহরের বিভিন্নস্থানে গত বয়েক বছরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কম্পিউটার সেন্টার। ২০ থেকে ২৫ টাকায় তারা প্রতি পৃষ্ঠা বাংলা-ইংরেজি কম্পোজ করেন। স্বচ্ছতা ও দ্রুততার জন্যই টাইপ রাইটিং গ্রাহকরা এখন কম্পিউটারমুখী। তবে এ ধরনের সেন্টারগুলোতে মূল সমস্যা বিদ্যুৎ না থাকা। সেই অনাদীকাল ধরে মুদ্রাক্ষরিকদের সবচে বড় গ্রাহক আইন পেশার মানুষরা। মুদ্রাক্ষরযন্ত্রের বিলুপ্তিতে শঙ্কিত কুষ্টিয়া জেলা আইনজীবি সমিতির সভাপতি অ্যাড. হারুন-উর-রশিদ মনে করেন একমাত্র সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাই পারে শত বছরের পুরোনো এই পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে।
তিনি জানান, ২৯ বছর পূর্বে তিনি যখন আইন পেশায় যোগদান করেন সে সময় কুষ্টিয়ার আদালতপাড়ায় টাইপিষ্টের সংখ্যা ছিলো ২৫/৩০ জন। কিন্তু দিনে দিনে তা কমে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮/৯টিতে। মানুষ কম্পিউটারমুখী হওয়ায় টাইপ রাইটারের কাজ কমে গেছে, ফলে অনেকেই এ পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। ইতিহাসের এই মুদ্রাক্ষরযন্ত্রটি সংরক্ষণের মধ্যদিয়ে বিকশিত হবে আমাদের ঐতিহ্য এমনটিই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।