ঢাকা শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ফেনী মুহুরী সেচ উন্নয়ন প্রকল্প কৃষকের কাজে আসছে না

ফেনী মুহুরী সেচ উন্নয়ন প্রকল্প কৃষকের কাজে আসছে না

কৃষকের কাজে আসছে না সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার এ প্রকল্প। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)-র ৫৬২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলেও কৃষকরা বলছেন কোনো কাজেই আসছে না। মাঠে অবকাঠামো থাকলেও স্কিমগুলো অকেজো হয়ে আছে দীর্ঘদিন। বিগত আগস্টে ফেনীতে ভয়াবহ বন্যাকে দায়ী করছেন কর্তৃপক্ষ। পানির অভাবে ফসলের মাঠ এখন শুকিয়ে চৌচির। কৃষক আবাদ করতে পারছে না ধান-ফসল।

প্রকল্পের তথ্য মতে, বৈদ্যুতিক পাম্পের সাহায্যে প্রিপেইড মিটার ব্যবস্থায় ভূগর্ভস্থ পাইপলাইনের মাধ্যমে খাল থেকে জমিতে সেচের পানি সরবরাহ পদ্ধতি চালু করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ফেনীতে মুহুরী সেচ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। মাঝে করোনার কারণে দু-এক বছর কাজ বন্ধ থাকে। ২০২৪-এর জুনে কাজ শেষ হয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবির ৫৬২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা অর্থায়নে এ প্রকল্পের ৯টি প্যাকেজের মাধ্যমে এ প্রকল্পে কাজ করে। ফেনী জেলার পাঁচটি উপজেলা ও চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ৬ ও ৭ নম্বর প্যাকেজের প্রাক্কলিত মূল্যের ১৩ শতাংশ বেশি মূল্যে প্রায় ১৫৭ কোটি ১৮ লাখ ৪০ হাজার টাকার কাজ পান জার্মানির লুডভিগ ফাইফার হোচণ্ডউন্ড টিফবাউ জিএমবিএইচ অ্যান্ড কোং কেজি নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

ফেনীর মুহুরী সেচ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পের ৫৩৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ভূগর্ভস্থ পাইপলাইনের ৮৫০টি স্কিমের মধ্যে হস্তান্তর হয়েছে ৩৩৭টি স্কিম। এর মধ্যে চালু হয়েছে মাত্র ২৬৮টি। যেগুলো চালু হয়েছে সেগুলোর সিংহভাগই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রকল্পের ৬ ও ৭ প্যাকেজে ফেনীর পাঁচটি উপজেলা ও চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এ পর্যন্ত সেচ সুবিধা পেয়েছে মাত্র প্রায় ৩ হাজার হেক্টর। প্রকল্পের কার্যাদেশ অনুযায়ী এক নম্বর গ্রেডের ক্ষেত্রে দুই থেকে তিন নম্বর গ্রেডের ইট দিয়ে গাঁথুনি ও কংক্রিট দিয়ে ঢালাই কাজ করা হয়। কিছু জায়গায় ছাদ ঢালাইয়ের কাজে পাথরের পরিবর্তে নিম্নমানের কংক্রিট দিয়ে ঢালাই কাজ সম্পন্ন করা হয়। ভিটি বালি দিয়ে প্লাস্টার, গাঁথুনি এমনকি ঢালাইয়ের কাজও করেছে তারা।

কোথাও সিলেকশন বালির ব্যবহার হয়নি। নিম্নমানের ইউপিভিসি পাইপ ব্যবহার করা হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পাইপের দুইপাশে ও নিচে ৬ ইঞ্চি ওপরে ১২ ইঞ্চি বালি দেয়ার কথা।

মাঠে ড্যামেজ পাইপ ও ওয়েস্টেজ পাইপের টুকরা আগুনে পুড়িয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্কিম নির্মাণের ঘটনাও রয়েছে। স্কিমের নির্ধারিত দৈর্ঘ্যরে কম পাইপ স্থাপন করে বাড়তি দৈর্ঘ্য দেখিয়ে বিল উত্তোলন করা হয়। যার কারণে পানির ওভার ফ্লো হচ্ছে এবং স্কিমের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ডিস্ট্রিবিউশন বক্সে অন্তত ৬০ শতাংশ রড কম ব্যবহার করে ১০০ শতাংশ রডের বিল উত্তোলন করেছে। যে কোন একটি ডিস্ট্রিবিউশন বক্স চেক করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। ছাদে কার্যাদেশের চেয়ে ৫০ শতাংশ রড কম ব্যবহার করেছে যা প্রকল্পের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেছে। নির্মাণকাজে কার্যাদেশ অনুযায়ী রড ব্যবহার না করে নিম্নমানের স্ক্র্যাপ রড, বাংলা রড ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে কার্যাদেশ অনুযায়ী কাজ তদারকির কথা থাকলেও তা হয়নি।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্পের ৬ ও ৭ প্যাকেজের আওতায় ১৫৭ কোটি ১৮ লাখ ৪০ হাজার টাকার মধ্যে ১৩৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা তুলে নেয়ার পর সরকারের কাছে তাদের পাওনা প্রায় ২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে তাদের জামানতের পরিমাণও প্রায় ১৬ কোটি টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সবশেষ জমা বিলের প্রায় ১৭ কোটি টাকা দেয়া হলে সরকারের কাছে অবশিষ্ট থাকবে প্রায় ছয় কোটি টাকা। যা জামানতেরও কম।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, অবকাঠামোর অস্তিত্ব ঠিক থাকলেও পানি সরবরাহের অধিকাংশ স্কিমই অকেজো। কোথাও বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার নেই আবার কোথাও নেই মিটার। ফেনী সদর উপজেলার কালিদহে কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে কাজ করছে উঠছে না পানি। আজিজুল করিম বিপুল নামের এক কৃষক বলেন, স্কিম চলবে কীভাবে বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটারই নেই। ক’দিন পর পর চুরি হয়ে যায়। এই কৃষক জানান, ট্রান্সমিটার চুরির ঘটনায় স্থানীয়দের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজনও জড়িত রয়েছে।

স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, এ প্রকল্পটিতে চলেছে লুটপাট। পুকুর নয়, সাগরচুরি হয়েছে। কৃষকের স্বার্থে কথা বললেও হয়েছে উল্টোটা। কৃষক তেলের পাম্পে পানি তুলে সেচ দিলেও যে খরচ হয় এই প্রি-পেইড মিটার ব্যবস্থায় খরচ ধরা হয়েছে তার চেয়েও বেশি। আবুল হোসেন নামের এক কৃষক জানান, স্কিমগুলো অকেজো হয়ে রয়েছে। পাইপলাইন এলোমেলো পড়ে রয়েছে। প্রান্তিক কৃষকদের কোনো কাজে আসছে না।

আজগর উদ্দিন নামের সোনাগাজীর আমিরাবাদের এক কৃষক বলেন, আগে তেল দিয়ে পাম্পের মাধ্যমে যেভাবে পানি তোলা হতো। কথা ছিল সেই খরচ থেকে এই পদ্ধতিতে খরচ কমবে। কিন্তু সেটা না হয়ে হচ্ছে উল্টোটা। পানি ব্যবস্থাপনা ফেডারেশন বলছে কৃষক এই পর্যন্ত প্রকল্পের সুফল পাচ্ছেন না তারা। ৮০০-এর অধিক পাম্পের বেশির ভাগ অকেজো। কর্তৃপক্ষ কাজ না করে বন্যার অজুহাত সামনে এনেছেন। অপরদিকে কৃষি কর্মকর্তারা বলছে দ্রুত সেচ ব্যবস্থা সচল করতে না পারলে প্রভাব পড়বে আবাদে। মুহুরী সেচ প্রকল্প পানি ব্যবস্থাপনা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাইন উদ্দিন কামরান বলেন, কাগজে-কলমে ৮০০-এর বেশি পাম্প থাকলেও ৩০০ বেশি পাম্প কখোনোই চালু ছিল না। কর্তৃপক্ষ আগস্টের বন্যাকে ক্ষতির জন্য দায়ী করলেও প্রকল্পে লুটপাটের কারণেই এমন দশা।

ফেনী সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের আলোকদিয়া গ্রামের কৃষক আবুল কাসেম বলেন, জমিতে ট্রাক্টর ও পাওয়া ট্রলি দিয়ে চাষের পর ভূগর্ভস্থ পানি লাইনে নিম্নমানের পাইপ ব্যবহারের কারণে অধিকাংশ জায়গায় ঢেবে গেছে। ফলে সঠিকভাবে পানি প্রবাহ হচ্ছে না। অনেক জায়গায় পাইপ ভেঙে যাওয়ায় পানি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে না। নুরনবী বলেন, সিমেন্টের পাইপে কোনো রড বা জালি ব্যবহার না করায় পাইপ ফিটিংয়ের সময় অনেক পাইপ ভেঙে গেছে। তা ছাড়া শুকনো মৌসুমে খালে পানি থাকে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত