ঢাকা শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সুপেয় পানির সংকটে চরম ভোগান্তি

সুপেয় পানির সংকটে চরম ভোগান্তি

ফেনীতে পানি ওঠছে না ১ লাখ ৬৭ হাজার ৩৮৬ নলকূপে। পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রচণ্ড তাপদাহ আর অনাবৃষ্টির কারণে পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়াসহ বেশ কয়েকটি উপজেলায়। এসব এলাকায় প্রায় ৭০ শতাংশ টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। এতে হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। নলকূপ, পুকুর, খাল-বিলসহ কোথাও নেই পানি। ফলে অস্বাস্থ্যকর পানি পান করে ডায়েরিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। বৃষ্টি একমাত্র সমাধান বলে জানিয়েছেন জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী।

ফেনী জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ফেনী জেলায় মোট ৩৬ হাজার ৮১১টি নলকূপের মধ্যে ৯ হাজার ৮৭১টি নলকূপ দীর্ঘদিন থেকে অকেজো। ২৬ হাজার ৯৪১ চালু নলকূপের মধ্যে প্রায় অর্ধেক নলকূপের পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত অগভীর প্রায় দুই লক্ষাধিক নলকূপের অর্ধেকের বেশি নলকূপে সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

ফেনী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রাক্কলনিক (উপ-সহকারী প্রকৌশলী) এসএম মাহফুজুর রহমান জানান, গত বছরের আগস্টে ফেনীর ভয়াবহ বন্যায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ১৬ হাজার ৪১৫টি ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ২৭ হাজার ৬০০টি নলকূপ এখনো পুনঃস্থাপন ও মেরামত করা হয়নি। যার কারণে বন্যাকবলিত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় এমনিতে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে।

সরজমিনে ফুলগাজী উপজেলায় দেখা গেছে, অগভীর (৪০-৫০ ফুট) স্বাভাবিক নলকূপে একদমই পানি উঠছে না। অকেজো উপজেলার প্রায় ১৫ হাজার নলকূপ। পানির অভাব পূরণ করতে অনেকে দূর-দূরান্তে ছুটছেন। কাঙ্ক্ষিত পানি না উঠায় এবং বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ধান উৎপাদন নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন কৃষকরা। এলাকাবাসী বলছেন, এত টাকা খরচ করে বোরো ধানের চারা রোপণ করেছেন; কিন্তু অনাবৃষ্টি আর দাবদাহে জমির মাটি ফেটে যাওয়ায় বোরো ধানের ফলন নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। এতে ওই এলাকার বাসিন্দারা দূর-দূরান্ত থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন। এতে তাদের বাড়তি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তারা সরকারিভাবে প্রতিটি ওয়ার্ডে সুপেয় পানির সরবরাহ চান।

ফুলগাজী উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের উপ-সহকারী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আরমান বলেন, উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ৮৭টি গ্রামে সরকারি অগভীর নলকূপ ১ হাজার ৬১টি, গভীর নলকূপ ১ হাজার ১৮৮টি এবং সাবমার্সিবল পাম্পযুক্ত নলকূপ ৮৮৭টি। এছাড়া পরিবারগুলোতে ব্যক্তি উদ্যোগে রয়েছে প্রায় ১৭ হাজার নলকূপ। গড়ে ৭০ ভাগ নলকূপে পানি উঠছে না। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, তাই বৃষ্টির পানি একমাত্র ভরসা।

উপজেলার জি এম হাট ইউনিয়নের কুলসুম আক্তার শরিফা জানান, আমাদের শরিফপুর গ্রামের এই কাজী বাড়িতে ১১টি পরিবারের মধ্যে পাঁচটি পরিবারের মধ্যে রয়েছে গভীর নলকূপ। এসব নলকূপের একটিতেও মিলছে না সুপেয় পানি। তাই খাবার পানি ও রান্নাবান্নার পানি সংগ্রহে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। দূর-দূরান্তের জলাশয় থেকে পানি সংগ্রহ করে সেগুলো রান্না-বান্নাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেন তারা। শুধু এই বাড়ি নয়, আশপাশের অধিকাংশ বাড়ির নলকূপে মিলছে না সুপেয় পানি। যার ফলে সুপেয় পানি, রান্না-বান্না ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের পানি নিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের।

জিএমহাট ইউনিয়নের বসিকপুরের বাসিন্দা তানভীর আলম জানান, এই জিএমহাট ইউনিয়নের শ্রী চন্দ্র পুর গ্রামের ৩৫টি গভীর নলকূপের একটিতেও মিলছে না সুপেয় পানি। তাই খাবার পানি ও রান্নাবান্নার পানি সংগ্রহে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। দূর-দূরান্তের জলাশয় থেকে পানি সংগ্রহ করে সেগুলো রান্না-বান্নাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেন তারা। শুধু এই গ্রাম নয়, এই ইউনিয়নের প্রায় সব ওয়ার্ডের বাড়ির নলকূপে মিলছে না সুপেয় পানি। যার ফলে চরম পোহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের।

তনু সরকার নামের এক বাসিন্দা জানান, জিএমহাট ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরের গভীর নলকূপটি তিন বছর ধরে নষ্ট অকেজো। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এ সংকট দেখা দিয়েছে। সরকার যদি বিকল্প ব্যবস্থা করে সমস্যার সমাধান করে, তবে জনগণ উপকৃত হবে। একই চিত্র দেখা দিয়েছে- সোনাগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়াসহ সদর উপজেলায় বিভিন্ন বাড়িগুলোতে। ফলে পানি যোগাড়ে দূর-দূরান্তে ছুটছেন ভুক্তভোগীরা। এতে অনেকে পুকুর অথবা ডোবার অস্বাস্থ্যকর পানি পান করে ডায়রিয়াসহ পড়ছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

পাঠান নগর এলাকার কৃষক করিমুল্লাহ জানান, আমাদের নিজস্ব জমিগুলোতে এবার স্কিমধানের চাষ করেছি; কিন্তু পানির অভাবে ধানের থোড় এখন ভুষি হয়ে যাচ্ছে। পুকুর, জলাশয়ের ও খালের পানি শেষ হওয়ায় সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিএডিসি কৃষি জমিতে পানি দেয়ার কথা থাকলেও এখন দিতে পারছে না। তাই আমরা বিপাকে আছি। পুকুর, খাল ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় পানির অভাবে ফসল উৎপাদনে চরম সংকটে পড়েছেন তারা। দাঁগনভুঞা উপজেলার নলকূপের পানিতে লবণাক্তের জন্য পান করা যাচ্ছে না পানি।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী শফিউল হক জানান, অনাবৃষ্টির পাশাপাশি গরমের তীব্রতা বাড়ায় ভুগর্ভের স্তর নেমে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষিকাজে ভূর্গস্থ পানির অধিক উত্তোলনের ফলে প্রতি বছর পানির লেয়ার নিচে নেমে যাচ্ছে। যার ফলে শুষ্ক মৌসুমে অধিকাংশ নলকূপে পানি উঠে না। বৃষ্টি হলে পালি লেয়ার উপরে উঠে যাবে, তখন পানি পাওয়া যাবে।

ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সঙ্গে আলাপ করে নলকূপের তালিকা করে দূরের এলাকাগুলোতে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত