ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ফেনীর বেশিরভাগ নদী খাল অস্তিত্ব সংকটে

ফেনীর বেশিরভাগ নদী খাল অস্তিত্ব সংকটে

ফণী বা ফেনী নদীর নামানুসারে জেলার নাম ফেনী। শাখা নদী-খালের সঙ্গে স্রোতধারা বন্ধ হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে জলবদ্ধতা তৈরি হয়ে ফেনী শহরের রাস্তাঘাট অনেকটা নদীর মতো দেখা যায়। এছাড়াও ফেনী শহরের ট্রাংক রোডের পূর্ব পাশ জেল রোড পর্যন্ত খালটি অবৈধ দখলের কারণে বর্তমানে ড্রেনে পরিণত হয়েছে এবং কিছু কিছু স্থানে ড্রেনের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে গেছে। আরো বেশ কয়েকটি খাল অবৈধ দখলের কবলে পড়ে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। বিগত বছরের আগস্টের মাঝামাঝিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জলবদ্ধতার কারণে দীর্ঘ সময় পানি জমে থাকায় শহরে বসবাসরত মানুষের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। এছাড়া এ ভয়াবহ বন্যায় ফেনীতে শিশু, নারী ও বয়োবৃদ্ধসহ ২৯ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি বসতবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।

ফেনীর খাল-বিল আর শাখা নদীগুলো তথা সব ধরনের জলাধারের বেশিরভাগই দখল হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পলি মাটি জমে ভরাট হয়ে নাব্য হারিয়ে এবং ময়লা-আবর্জনায় জমে থাকায় দূষিত হয়ে কোথাও কোথাও নদী-খাল সংকোচিত হয়ে পড়েছে। এসব খালের পানির প্রবাহ ঠিক করা না গেলে বর্ষা মৌসুমে জলবদ্ধতার আশংকা করছে স্থানীয়রা। পৌরসভার পক্ষ থেকে খালগুলো পরিষ্কারের পদক্ষেপ নিলেও পুনউদ্ধারের কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেই। ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ফেনী পৌরসভার মেয়র ছিলেন নিজাম উদ্দিন হাজারী ও হাজী আলা উদ্দিন। তারা পৌর এলাকার খাজা আহম্মেদ লেক, পাগলীর চড়া খাল, জেল রোডের পিটিআই সংলগ্ন খালের ওপর নির্মাণ করেছেন মার্কেট। ফলে কোথাও খাল বন্ধ, আবার কোথাও হয়েছে সংকুচিত। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে পৌর বাসিন্দাদের। এছাড়া রয়েছে অব্যবস্থাপনাও। এখনকার এ শহরের হালের প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্প মনে হলেও দখল-দূষণে মৃতপ্রায় শহরের দমদমা খাল। এ খালেই এক সময় চলাচল করতো মালবাহী বাণিজ্যিক নৌকা। ছোট-বড় নৌকাগুলো ভিড়তো শহরতলীর দাউদপুল এলাকায়। সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নানা পণ্যের সমারোহে বসতো মাসব্যাপী রাসমেলা। ফেনী শহরের দোকান মালিকদের মালামাল আনা-নেয়া ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম ভরসা ছিল এ খাল।

ফেনী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আলাল উদ্দিন আলাল বলেন, আমরা নিজ চোখে দেখেছি ফেনী শহরের দাউদপুল এলাকার বর্তমানের দূষিত খালে এক সময় নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসতো নৌকা। সেসব বাণিজ্যিক নৌকা ভিড় করতো এবং পণ্য ওঠাণ্ডনামা করতো। সেসব পণ্য যেত জেলার বিভিন্ন এলাকায়। শহরের পূর্ব উকিল পাড়ার বাসিন্দা নুরুল আলম জসিম বলেন, খালগুলো দিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কাঠের তৈরি জিনিসপত্র আসতো। খাল পাড়েই প্রায় এক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে রাসমেলা বসতো। সেই মেলা চলতো মাসব্যাপী। এখন সেই খালও নেই, রাসমেলাও নেই। ক্রেতা-বিক্রেতাদের মিলন মেলার উৎসবও নেই। দমদমা খাল সংলগ্ন শহরের গোডাউন কোয়ার্টার এলাকার বাসিন্দা রিয়াজুল হক বলেন, গত বছর খালটির গাজি ক্রস রোড অংশে পৌরসভা আরসিসি স্ল্যাব বসিয়ে এটিকে ড্রেন বানিয়ে ফেলেছে। পানিপ্রবাহের গতিরোধ হওয়ায় এতে সামান্য বৃষ্টিতে একাডেমি এলাকার নিম্নাঞ্চল ডুবে যায়।

ফেনী শহরের বাসিন্দা মানবাধিকার কর্মী শরীফুল ইসলাম রাসেল জানান, শহরের দাউদপুর খাল ও পাগলিছড়া খালের পাশে প্রতিনিয়ত ময়লা-আবর্জনা ফেলে খাল দখল করা হয়েছে। আড়তের ময়লায় শুধু খালের পানি দূষণই হচ্ছে না, সেই সঙ্গে বন্ধ হচ্ছে পানির প্রবাহ। শহরের অন্য খালগুলোর দশাও প্রায় এক। এসব খাল সংস্কারের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আমরা মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবো। ফেনীর বেশির ভাগ খাল হয় বেদখলে, বেহাল, না হয় দূষণে ভরাট হয়ে আছে। ফলে সেগুলো দিয়ে শহরের পানি দ্রুত নামতে পারছে না। ভয়াবহ বন্যায় যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার মূলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখেছে ফেনীর ছয় উপজেলার অন্তত ২৪৪টি খাল ও শাখা নদীর দখল-দূষণ। এবারের বন্যায় দুর্ভোগে পড়ে জেলার অন্তত ১৮ লাখ মানুষ। শুধু এবারের বন্যাই নয়, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ভারি বর্ষণ ও ভারতীয় উজানের পানিতে সৃষ্ট বন্যায় মানুষজনের পাশাপাশি ক্ষতির শিকার হয় ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, পুকুর-খামার ও গবাদিপশু। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পৌর কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় উদ্যোগ নিয়েও খাল ও শাখা নদীগুলোর অবৈধ স্থাপনা নানা জটিলতায় উচ্ছেদ করতে পারেনি, খালও সংস্কার করতে পারেনি। ফেনী শহর ঘুরে দেখা যায়, দাউদপুর খাল ও পাগলিছড়া খালের পাশে প্রতিনিয়ত ময়লা-আবর্জনা ফেলে দখল করা হয়েছে।

অন্যদিকে দাগনভূঞা উপজেলার রাজাপুর বাজারসংলগ্ন ‘দত্তের খালটি’ দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় এবং আশপাশের ময়লা-আবর্জনা ফেলায় ও দখল-দূষণের কারণে বর্তমানে এটি অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। দাগনভূঞার এমন আরেকটি খাল হল ‘দাদনা খাল’। ১৯ কিলোমিটার বিস্তৃত খালটি স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পেটে চলে গেছে। দাদনা খালের প্রশস্ততা ৬৫ ফুট হলেও এখন ১০ ফুট বা কোথাও ১৫ ফুট টিকে আছে। উপজেলা প্রশাসন ও পৌরসভার ঠেলাঠেলির সুযোগে দখলদাররা দখল করে রেখেছে খালটি। ছোট ফেনী নদীর সঙ্গে সংযোগ থাকা একাধিক শাখা খাল তাদের নাব্যতা হারানোয় পানি ধীরগতিতে নামছে। ফেনীর আরেক উপজেলা সোনাগাজীর ডাঙ্গি খাল এখন নালায় পরিণত হয়েছে। খালের চারপাশে ও উপরে বিভিন্ন সময় প্রভাবশালীরা স্থাপনা নির্মাণ করে দখল করায় পানিপ্রবাহ কমে গেছে।

সোনাগাজীর ৫৬টি, দাগনভূঞার ৫২টি, সদর উপজেলার ৩৯টি, পরশুরামের ৪টি, ছাগলনাইয়ার তিনটি ও ফুলগাজীর সবকটি খালই দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। পাউবো সূত্র জানান, ফেনী জেলায় ও মুহুরী প্রজেক্ট (চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর কিছু অংশ) এলাকায় ২৪৪টি খাল ও শাখা নদী রয়েছে। এসব খাল ও নদীর ৭১৯ কিলোমিটার অংশের মধ্যে বিগত পাঁচ বছরে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পুনঃখনন করা হয়েছে। ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, বন্যায় জলবদ্ধতা ও মানুষের দুর্ভোগ কমাতে বরাদ্দ পেলে ফেনীর নদ-নদী ও খালগুলো খনন ও সংস্কার করে পানির গতির প্রবাহ স্বাভাবিক করা হবে। শহরের খালগুলো দীর্ঘদিন খনন বা সংস্কার না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব এলাকার খাল সংস্কার করবে স্ব-স্ব কর্তৃপক্ষ। এ জনপদের প্রবীণ সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের জানান, খাল দখলের এ প্রক্রিয়া এক, দুদিনের নয়। গত ৩০ থেকে ৪০ বছর ধারাবাহিকভাবে খালগুলো একটু একটু করে দখল হচ্ছে। অনেক খাল কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে বিলীন। এসব খাল ও পানির প্রবাহ ধ্বংস করার করুণ পরিণতি এবারের বন্যায় মানুষ দেখেছে। বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার বড় কারণ পানির প্রবাহগুলো নষ্ট হওয়া। ফেনী পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাকির হোসেনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত কিছুদিন আগে পৌরসভার পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে খাল সংস্কার কার্যক্রম উদ্বোধন করেছি। আশা করি বর্ষা মৌসুমের আগেই খালগুলোর সংস্কারের কাজ শেষ হবে।

ফেনী পৌর এলাকার খালগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাওয়া বিষয়ে জানতে চাইলে পৌর প্রশাসক গোলাম মো. বাতেন জানান, খালগুলো দূষণ থেকে রক্ষা করার বিষয়ে পৌরসভার পক্ষ থেকে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী বর্ষায় জলবদ্ধতা থেকে রেহাই পাবে পৌরবাসী। খালগুলো অবৈধ দখলের ফলে অস্তিত্বহীন হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খালগুলো পুনঃউদ্ধারে নানা জটিলতার কারণে সম্ভব হচ্ছে না। তবে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থার পর ক্রমান্বয়ে অবৈধ দখল থেকে খালগুলো উদ্ধারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত