ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দখল-দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে নরসুন্দা

দখল-দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে নরসুন্দা

কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার জবদুল মাঝি, বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। এক সময় আসতেন নরসুন্দা নদীতে মাছ ধরতে। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যায় যা মাছ পেতেন, বেচে চলে যেতেন বাড়িতে। দিব্যি তার সংসার চলত নরসুন্দার মাছে। তিনি এখনো আসেন নরসুন্দার তীরে। তবে মাছ ধরতে নয়, তীরে গড়ে ওঠা দোকানে চা পান করতে। মাঝি বলেন, এক সময় এই নদীতে পাল তোলা নৌকা ভিড়ত। পণ্য নিয়ে আসা নৌকাগুলোকে ঘিরে রোজগার হতো মানুষের। মাছ ধরেও চলত অনেকের সংসার। এখন নদীতে ধান চাষ হয়। তাড়াইল উপজেলার এক ঐতিহ্যবাহী নদী ‘নরসুন্দা’। এ নদীর আরেক নাম ‘নাগচিনি’।

নরসুন্দা নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে পুনঃখননের জন্য সরকারিভাবে বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু নদীটির করুণ অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ঐতিহ্যবাহী নরসুন্দা নদীর দুই পাশ দখলে দূষণে এখন সরু নালায় পরিণত হয়েছে। এক সময় নরসুন্দা নদীটি ছিল পানিতে টইট¤ু^র। এখানে মাছ ধরে সংসার চালাতেন আশপাশের মানুষ। সেই দিনগুলো ক্ষীণ হয়ে আসে ১৯৮০ সালের দিকে। দখলে বড়াল হয়ে উঠেছে সরু নালা। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। অসংখ্য নদ-নদী মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এ দেশে। তাই নদ-নদীর সঙ্গে এ দেশের মানুষের সখ্য, প্রেম সুদূর অতীত থেকেই। এমনকি নদীপথই এক সময় মানুষের যাতায়াতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। কিন্তু অবহেলা, অনাদর বা প্রাকৃতিক কারণে দেশের অনেক নদ-নদী এখন মৃতপ্রায় অবস্থা। নদী রক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপও নেই। দখলে-দূষণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে অসংখ্য নদী। পলি জমে অনেক নদীর গতিপথ বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা, ঘরবাড়ি, শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে আর এভাবেই মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক নদী।

স্থানীয়রা জানান, নরসুুন্দা নদীর আশপাশে যারা বসবাস করছেন, তারা নদী দখল করে সেখানে ধান, সবজি চাষ করেন। প্রভাবশালীরাও আছেন এই তালিকায়। স্থানীয় আবদুুস সালাম জানান, নরসুন্দায় এখন ধান চাষ হয়। দিন দিন নরসুন্দা দখল হয়েই যাচ্ছে। সরু নালার মতো এখন যেটুকু আছে, তা রক্ষার উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান তিনি। নরসুন্দার তীরবর্তী বাসিন্দারা জানান, এখনই সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করে নদীটি পুনঃখনন করা না হলে নরসুন্দা নদীই এক দিন হারিয়ে যাবে মানচিত্র থেকে। তাড়াইল উপজেলার সচেতন মহল জানান, বিভিন্ন স্থানে স্লুইস গেট ও বাঁধ নির্মাণের ফলে নরসুন্দা নদী শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। বর্ষায় নদীতে কিছু পানি জমলেও শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়। এবারও তাই হয়েছে। এলাকার কৃষকরা নদীর বুকজুড়ে বিভিন্ন ফসল আবাদ করছেন। শুষ্ক মৌসুমে পরিণত হয় গবাদিপশুর চারণক্ষেত্র। এক সময় যে নরসুন্দার পানিতে নদী তীরবর্তী মানুষ তাদের জমিতে ফসল ফলাত, এখন সে নদীর বুকে অগভীর নলকূপ বসিয়ে হয় ধান চাষ। নদী আছে, নৌকা আছে, নেই শুধু পানি। কিন্তু এক সময় এ নদী দিয়ে বড় বড় লঞ্চ, ট্রলার যাতায়াত করত। নদীতে পাওয়া যেত নানা রকমের মাছ। এখানকার দিন-রাতগুলো মুখরিত থাকত হাজার হাজার পাখির কলকাকলিতে। বর্ষায় পানিতে থাকত ভরপুর। এখন এসব শুধুই ইতিহাস। ময়লা-আবর্জনায় নদীটি ভরাট হয়ে দিনেদিনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। কচুরিপানা আর ময়লার জন্য পানি প্রবাহের সামান্য সুযোগও নেই। মাঝেমধ্যে কোথাও ডোবার মতো অল্প পানি জমে আছে। প্রশাসন নদীটি রক্ষায় কার্যকর কিছুই করেনি। নদীটির অস্তিত্ব এখন পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে।

নরসুন্দার অবয়ব থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে নদীর চিহ্ন। কঙ্কালসার অস্তিত্ব নিয়ে শুধু টিকে আছে নদীর নামটি। অস্তিত্ব বিলীন হতে যাওয়া নরসুন্দা রক্ষায় সবার এগিয়ে আসা উচিত। সরকারকে দেশের নদী রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নরসুন্দা নদীটি খনন করে হাওড়ের সঙ্গে পানি চলাচলের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে নরসুন্দা আবার প্রাণ ফিরে পাবে। নরসুন্দার সঙ্গে এখানকার জনসাধারণের রয়েছে গভীর মমত্ববোধ আর প্রবল ভালোবাসার টান। নরসুন্দাকে বাঁচাতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত