ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ কম বিপাকে শুঁটকি উৎপাদনকারীরা

প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ কম বিপাকে শুঁটকি উৎপাদনকারীরা

হবিগঞ্জ জেলায় হাওড় বিল নদীসহ প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন শুঁটকি উৎপাদনকারীরা। আগে হাওড়ে ১৫০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এখন মাত্র ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যাচ্ছে। বাকি নানা প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে।

এ অবস্থায় শুঁটকি তৈরির জন্য যে কাঁচামাল প্রয়োজন তা পর্যাপ্ত পরিমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে কমছে শুঁটকির উৎপাদন। এতে হতাশায় রয়েছেন জেলার শুঁটকি উৎপাদনকারীরা। তারপরও জেলার আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, লাখাই, বাহুবল, হবিগঞ্জ সদর ও নবীগঞ্জ উপজেলার ৫ শতাধিক পরিবার শুঁটকি উৎপাদনের পেশায় জড়িত রয়েছেন। পেশা টিকিয়ে রাখতে তারা সরকারি সহায়তা চেয়েছেন। এ জেলার হাওড় এলাকার বাঘহাতা, গাজীপুর, শান্তিপুর, ভাটিপাড়া, সুনারু, নাগুরা, নোয়াগাঁও, নোয়াগড়, বিরাট, কোদালিয়া, বদলপুর, উমেদনগরসহ বিভিন্নস্থানে রয়েছে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের অসংখ্য মাচা।

মাচায় দেশীয় প্রজাতির পুঁটি, চিংড়ি, কাকিয়া, শইল, গজার, টাকি, বাইম, আইড়, মলা, টেংরাসহ বিভিন্ন প্রজাতি মাছের শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত শুঁটকি প্রতি মণ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আড়তদাররা প্রতি মণ ২৫ থেকে ২৮ হাজারে বিক্রি করছেন। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ হিসেবে প্রতি মণ ২৮ থেকে ৬০ হাজার টাকা। এখানে শুঁটকি উৎপাদনকারীরা তেমন একটা লাভবান না হলেও লাভবান হচ্ছেন আড়তদার, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা। ক্রেতারা কয়েক গুণ বেশি মূল্য দিয়ে শুঁটকি ক্রয় করছেন। এরমধ্যে আবার শুঁটকির উৎপাদন কমে যাচ্ছে। জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়- গত অর্থবছরে হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় ২৪০ টন, বানিয়াচংয়ে ৫৭৫ টন, নবীগঞ্জে ২৭ টন, বাহুবলে ২১২ টন, লাখাইয়ে ২৩১ টন এবং আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় ৩৪২ টন শুঁটকি উৎপাদন হয়েছিল। যা এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫ শতাংশ কম। এ মৌসুমে আরও কম উৎপাদন হয়েছে। হবিগঞ্জে উৎপাদিত শুঁটকিতে কেমিক্যাল ব্যবহার হয় না বলে এর স্বাদ ও কদর সবসময় আলাদা। কিন্তু এ বছর শুঁটকি উৎপাদনকারী ও ক্রেতাদের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে।

মাধবী রানী, আশুলতা রানী, সজলা রানী দাশ ও পারুল রানী দাশ, মিজান মিয়া, ভিংরাজ মিয়া, আলফু মিয়াসহ উৎপাদনকারীরা বলছেন, বাজার থেকে উচ্চমূল্যে পাইকারি দামে শইল, বাইম, পুটি, টেংরাসহ নানা প্রজাতির মাছ কিনে এনে শুঁটকি তৈরি করা হয়। তবে হাওড়, বিল ও নদীতে পানি কমে যাওয়ায় চাহিদামতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার চাহিদাসম্পন্ন মাছের দামও অনেক বেশি। তারা আরও বলছেন, আগে জেলা শহরের উমেদনগরে মাসে ৮টি পাইকারি শুঁটকির হাট বসতো। এখন বসছে মাত্র ৪টি। শুঁটকি শ্রমিকদের ভাষ্য- সকাল ৬টা থেকে কাজ শুরু করে দৈনিক ৫ ঘণ্টা কাজ করে মাসে ১০ হাজার টাকা মজুরি পান তারা। বর্তমানে শুঁটকির উৎপাদন কমে যাওয়ায় এ পেশায় কাজ করে খাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এজন্য তারা অন্য পেশায় চয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

বাজার ঘুরে দেখা যায়- টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ক্রেতারা আসেন হবিগঞ্জের এই সুস্বাধু শুঁটকি মাছ কিনতে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী শুঁটকি তারা পাচ্ছেন না। এতে তারা হতাশ হয়েছেন। সিরাজগঞ্জ থেকে পাইকারি দামে শুঁটকি কিনতে আসা ব্যবসায়ী মাসুদুর রহমান জানান, আগে প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ বার হবিগঞ্জে শুঁটকি হাট করতে আসতেন। এখন মাসে ২ থেকে ৩ বার আসেন। কারণ চাহিদামত শুঁটকি পাওয়া যায় না। আবার দামও আগের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। তাই সবমিলে এই ব্যবসায় অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এ অবস্থায় তার ন্যায় অন্যান্য ক্রেতারা হতাশ হয়েছেন।

উমেদনগর হাটে শুঁটকির আড়তদার কামরুল ইসলাম বলেন, আগে এই হাটে নানা রকমের শুঁটকি বিক্রি হতো। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্রেতারা এসে নিয়ে যেত। আমাদের এখানে উৎপাদিত শুঁটকি সুস্বাধু ও মজাদার বলে কদর আলাদা। বর্তমানে হাওড়, বিল ও নদীতে মাছ কমায় শুঁটকির উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, জেলায় অনেক নদী, বিল, হাওড়সহ বিস্তীর্ণ জলাশয় রয়েছে। নানা শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষিত কালো পানি প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রবেশ করছে। জমিতে অধিক পরিমাণে কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে। জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে বর্তমানে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের পরিমাণ কমেছে। তার সঙ্গে কমেছে শুঁটকি উৎপাদন। এর আগে জলাশয়ে নানা প্রজাতির প্রচুর দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। অধিক পরিমাণে উৎপাদন হতো শুঁটকির।

তিনি বলেন, এখনই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে, না হলে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে পর্যায়ক্রমে দেশীয় মাছ হারিয়ে যাবে। তার সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে শুঁটকি উৎপাদনও। জেলা মৎস কর্মকর্তা মোহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমান মজুমদার বলেন, দিনে দিনে হবিগঞ্জে শুঁটকির উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অনেকে এই পেশাল প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। আমরা মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য হাওড়ে বিভিন্ন ধরনের অভিযান করছি। বিশেষ করে পোনা মাছ সংরক্ষণের জন্য। যদি পোনা মাছ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়, তাহলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া চায়না দুয়ারী ও কারেন্ট জালের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। দেশীয় মাছ রক্ষা পেলে শুঁটকির উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত