কুমিল্লার পুরাতন বা মরা গোমতি নদী। এ নদীর দুই পাড়ের জায়গা ভরাট করে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা। অব্যাহত দখল আর দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে এ নদী। তবে স্থানীয় প্রশাসন এ নদীর ৭৭২ জন দখলদার চিহ্নিত করে গত ২২ বছরে অন্তত ৯ দফা উচ্ছেদ নোটিস দিলেও কোনো কাজ হয়নি। দখলদারদের অধিকাংশই প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ার হওয়ায় বছরের পর আটকে আছে উচ্ছেদ কার্যক্রম।
এক্ষেত্রে পরিবেশবাদীরা প্রশাসনের নির্লিপ্ততাকে দুষছেন। এদিকে দখলদারদের উচ্ছেদে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় সরকারি সম্পত্তি বেহাত হওয়ার পাশাপাশি নদীর দুই তীরের অন্তত অর্ধলক্ষাধিক মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছেন। নদী এলাকায় ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরেজমিন গেলে নদীর পাড়ের বাসিন্দারা জানান, এ নদীর পানিতে মরা গরু, হাঁস-মুরগি, কুকুর-বিড়াল, পশু-পাখি ছাড়াও কচুরিপানা, আবর্জনা এবং ফেনসিডিলসহ নেশাজাতীয় মাদকদ্রব্যের বোতল ভাসতে দেখা যায়। এছাড়া শহরের ড্রেনের ময়লা পানি সরাসরি গড়িয়ে পড়ছে মরা নদীতে, যা থেকে উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ নদী তীরে রয়েছে অসংখ্য ঝুলন্ত খোলা পায়খানা। নদীর কচুরিপানার ফাকে-ফোঁকড়ে এই পানিতেই নিম্নবিত্ত ও ভাসমান পরিবারের শিশু-কিশোরেরা গোসল করে, সাঁতার কাটে, মহিলারা রান্নাবান্নায় ধোয়া-মোছার কাজ করে।
সূত্র জানায়, একসময় কুমিল্লা শহর ঘেঁষে প্রবাহিত গোমতি নদীর পানি বর্ষাকালে বৃদ্ধি পেলে বাঁধ ভেঙে শহর তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় শহরবাসীর মাঝে আতঙ্ক ছড়াতো। তাই শহর রক্ষার জন্য ষাটের দশকে এ নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। এরপর থেকে শহরের উত্তর প্রান্তের কাপ্তানবাজার হতে পূর্ব প্রান্তের টিক্কারচর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার নদীর অংশ পুরাতন গোমতি নদী বা মরা নদী নামে পরিচিতি লাভ করে। তখন থেকে স্থানীয়রা সুযোগমতো পুরাতন গোমতী নদীর বিভিন্ন স্থানের দুই পাড় ও পানির অংশ ধীরে ধীরে অবৈধভাবে দখলে নিয়ে নির্মাণ করে বহুতল ভবন, আধাপাকা বাড়িঘর ও দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা।
এতে বিস্তীর্ণ নদী দখলযজ্ঞে সরু খালের আকার ধারণ করছে। আদর্শ সদর উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, পুরাতন গোমতি নদীর দুই পার্শ্বের ৭৭২ জন অবৈধ দখলদারের একটি তালিকা করা হয়েছে। তাদের উচ্ছেদের জন্য ২০০৩ সাল থেকে ৮-৯ দফা নোটিস দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নদীর অবৈধ দখলীয় কৃষি-অকৃষিসহ মোট ২৫৮.০২ একর জমি দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে জেলাপ্রশাসকের নিকট তথ্য দিয়েছিলেন। এরপর ২০১৬ সালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় কর্তৃক ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হলেও অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ হয়নি। কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি লুৎফুর রহমান বলেন, ষাটের দশকে শহর রক্ষার জন্য গোমতী নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়, যা পরবর্তীতে মরা গোমতী নামে পরিচিতি পায়। বর্তমানে দখল-দূষণে ধুঁকে ধুঁকে এ নদীর অস্তিত্ব অনেকটা বিলীনের পথে। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করা গেলে এ মরা নদী ঢাকার হাতির ঝিলের মতো পর্যটনের এক নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাছুম বলেন, এই প্রাকৃতিক জলাধার প্রতিদিন প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে। নদীতে আবর্জনা ফেলে দখল করা হচ্ছে। এর অস্তিত্বরক্ষায় সভা, সেমিনার জনসচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি পালন করেছি, স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখছি না।
কুমিল্লা জেলাপ্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার বলেন, পুরাতন গোমতি নদী ঘিরে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন এলাকা গড়ে তোলার জন্য জেলাপ্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সিটি কর্পোরেশন সমন্বয়ে মহাপরিকল্পনা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। এজন্য নগর পরিকল্পনাবীদ ও স্থপতিদের পরামর্শ নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। পুরাতন গোমতি নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে নদীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।