ঢাকা শনিবার, ০৩ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নিরাপদ খাদ্য, নিরাপদ স্বাস্থ্য

নিরাপদ খাদ্য, নিরাপদ স্বাস্থ্য

জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবসের ভাবনা ভেজালমুক্ত খাদ্য ও নিরাপদ স্বাস্থ্য। সুষ্ঠু, সবল ও প্রত্যয়দীপ্ত জাতি গঠনের অন্যতম একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি যদি নির্ভেজাল খাদ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করা না যায়, তবে সে জাতি ধীরে ধীরে পঙ্গুত্বের দিকে ধাবিত হবে। আধুনিক বিজ্ঞান সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে নিরাপদ খাদ্য অপরিসীম ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের সার্বভৌম বাংলাদেশের ঊষালগ্ন থেকেই মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্যের চিন্তাকে প্রসারিত করেছিলেন। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা এ বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারায় খাদ্য সংস্কৃতির বিষয়টি বিশেষত্ব লাভ করে বাঙালির ঐতিহ্যকে মহিমান্বিত করেছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মানুষ নানা দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখনও প্রায় প্রতি বছরই আমাদের আঘাত হানছে; কিন্তু দুর্ভিক্ষকে আমরা জয় করতে সক্ষম হয়েছি। যুগের ব্যবধানে লোকসংখ্যা বাড়ছে, কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে দ্রুতগতিতে। ফলে খাদ্যপণ্য উৎপাদনের ভূমি সংকোচিত হয়ে এলেও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সুদৃঢ় রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুউচ্চ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে খাদ্যপণ্য উৎপাদনে বিস্ময়কর বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার কাক্সিক্ষত স্বপ্ন তারই কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে বাস্তবে রূপলাভ করছে। খাদ্য ঘাটতির দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পাশাপাশি খাদ্য রপ্তানিযোগ্য দেশের কাতারে নাম লিখাতে অগ্রসর হচ্ছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বদ্বীপ এবং সীমিত উচ্চভূমি ছাড়া বিস্তীর্ণ সমভূমির অপরূপ মানচিত্র। মৌসুমি জলবায়ুর এ দেশটিকে ভূপ্রকৃতি অনুসারে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন (১) পাহাড়ি এলাকা, (২) সোপান অঞ্চল ও (৩) পাললিক সমভূমি। প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক গঠনের দিক থেকে অত্যন্ত উর্বর ও মানবসভ্যতা বিকাশের অনুষঙ্গ হিসেবে দেশটি বিবেচিত। ষড়ঋতুর এ দেশটি বিশ্বের অন্যতম শান্তিপ্রিয় বাসযোগ্য ভূমির মর্যাদায় অভিসিক্ত। রাজনৈতিকভাবে দীর্ঘ সময় এ দেশের মানুষ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। সে সময় ছিল না কোনো খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পরিধেয় বস্ত্র ও বাসস্থানের নিরাপত্তা। আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। আমরা অর্জন করি, অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যের অধিকার। কিন্তু মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে আবার অধিকারহারা হই। বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রকৃতির বিধানেই বিদেশে অবস্থান করছিলেন বলে বেঁচে যান। রাজনৈতিক নানা ঘটনা পরম্পরায় এ জাতির নেতৃত্বে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে শেখ হাসিনার অভ্যুদয় ঘটে। তিনিই আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের। জাতির আত্মমর্যাদার ভিত্তিকে মজবুত করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার অণুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খাদ্য ব্যবস্থার টইটুম্বুর অবস্থানকে ভেজালহীন করতেই নিরাপদ খাদ্য দিবসের সূচনা করা হয়। কেননা, কোনো অঙ্গীকার বাস্তবায়নে একটি সুনির্দিষ্ট সময়-তারিখ নির্ধারণ করতে হয়। শপথের অনুগামিতায় ফেব্রুয়ারি ২ তারিখটিকে বেছে নেওয়া। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দিনটি জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থার পথকে গতিশীল করতে পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ‘নিরাপদ খাদ্য সংস্থা’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে জনগণের কল্যাণে। খাদ্য বিষয়ে উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির শালুক সচেতনতায় এ প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। আমরা জানি, মানব জাতির সাবলীল চেতনাকে বলিষ্ঠ করতে শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নয়, নির্ভেজাল খাদ্য ব্যবস্থাও গড়ে তোলার বিকল্প নেই। দৈনন্দিন জীবনে মানুষ কী খাদ্য গ্রহণ করছে, কেমন খাদ্য গ্রহণ করছে, তার বিশ্লেষণ খুবই দরকার। একজন মানুষকে সুস্থ ও সবল থাকতে হলে খাদ্যগুণের সামষ্টিক বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সে জন্যই একেবারে শতভাগ ভেজালমুক্ত খাদ্যব্যবস্থা অপরিহার্য।

বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশ যখন সব ক্ষেত্রে ক্ষিপ্র গতিতে উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তখনই একশ্রেণির লোভি অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ী উন্নয়নের ঢেউয়ের সঙ্গে ভেজাল খাদ্যের ঢেউ মিলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। তাদের ব্যর্থ করে দিতে সরকার দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। সব ধরনের ভেজাল নিরসনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। কথায় আছেÑ মাছে-ভাতে বাঙালি। এ কথা এখন আপেক্ষিক সত্য হিসেবে বিবেচিত, উচ্চতর সত্য নয়। মাছ-ভাতের পাশাপাশি কথিত ফাস্টফুডের চাহিদা দ্রুততার সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবী এখন গ্লোবাল ভিলেজ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক আধুনিক খাদ্য সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ইউরোপিয়ান তথা পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের খাদ্যবস্তুর সঙ্গে সমন্বিত অবস্থান বিরজমান হয়েছে। বাঙালির নবপ্রজন্ম চিরায়ত বাংলার খাবারের চাইতে বৈদেশিক খাদ্যের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে। এ অবস্থায়, এসব খাদ্যের চাহিদাকে পুঁজি করে আমাদের দেশেও অনুরূপ খাদ্য প্রস্তুত হচ্ছে; কিন্তু তা কতটা নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মত হিসেবে প্রস্তুত হচ্ছেÑ সেটাই বিবেচ্য বিষয়। এসব খাদ্যের গুণগত মান যদি ঠিক না থাকে, তবে স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়তে হবে আমাদেরকে। আজকের তরুণ যুবকরাই আগামী দিনের নেতৃত্বে আসীন হবে। জাতিকে শক্তিশালী করতে যথাযোগ্য নেতৃত্বের কথা মাথায় রেখেই আমাদের ভেজালমুক্ত খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। কেননা, ভেজালযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে মেধা বিকশিত হবে না সুস্বাস্থ্য গড়ে উঠবে না, তখন নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এক বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হবে। তাই শক্তিশালী জাতি গঠনে শক্তিশালী খাবার অপরিহার্য।

আমাদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ও উন্নতির জন্য প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। আজকের সব প্রগতিশীল চিন্তার একটিই বিষয়Ñ মানুষের উন্নতি, বিকাশ এবং পরিপূর্ণতা। বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উন্নত জীবন বিকাশে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টিই সমধিক বিবেচিত। নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হতে পারলে গৌরবময় অতীতকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ আরও মহান আরও সৃজনমুখী এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। আমাদের অগ্রগতির পেছনে দুটি মহান শক্তি কাজ করে। প্রথমটি সৃজনশীল বুদ্ধিমত্তা এবং দ্বিতীয়টি চরিত্রবল। জাতি হিসেবে আমাদের বুদ্ধিমত্তার অভাব ছিল না। কিন্তু অদূরদর্শী সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের দরুন বুদ্ধির সে অনুশীলন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সে যাই হোক, সমাজ সচেতনতার অভাবে আমাদের চরিত্র তৈরি হতে পারেনি এবং চরিত্র গঠনের দিকে দৃষ্টি না দেওয়ায় আমাদের বুদ্ধি তার গতিময়তা হারিয়েছিল। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। আমাদের সৃজনশীলতা যেন লোপ পেতে বসেছে। তবে নির্ভেজাল খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে ওপরে টেনে তোলা কোনো কঠিন কাজ হবে না। নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থার আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে আমি যখন খাদ্য মন্ত্রণালয়ে খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন প্রতিটি রান্না ঘর থেকেই নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনের কথা বলেছিলাম। আমি মনে করি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পরিবেশ ছাড়া নিরাপদ খাদ্য প্রস্তুত সম্ভব নয়। যেখানে খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হয়, একই সঙ্গে যেখানে পরিবেশন করা হয় উভয় জায়গা যদি পরিচ্ছন্নতা না হয়, তবে ভেজালমুক্ত খাদ্য প্রস্তুত সম্ভব নয়। সবকিছু ঠিকঠাক মতো ব্যবহার করা সত্ত্বেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে খাদ্যে ভেজাল সৃষ্টি হবে নিজের অজান্তেই। নিজ গৃহের মানুষ সে খাদ্য গ্রহণ করে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।

আজ বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন দেশে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। মানব সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানো বড়ই কষ্টসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষিত না হলে ভেজালমুক্ত খাদ্য পণ্য উৎপাদনও সম্ভব নয়। অতিমাত্রায় রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারে উৎপাদিত খাদ্য-শস্য সুস্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর নয়। তাই রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার সীমিত করা দরকার। মানবিক চেতনাসম্পন্ন বুদ্ধি, অনুভূতি, ইচ্ছাশক্তির সহায়েই মানুষ নির্ভেজাল খাদ্য উৎপাদন করতে পারবে। খাদ্যশস্য উৎপাদন ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ও খাদ্য বস্তু প্রস্তুতকরণে চরিত্র নৈপুণ্য দরকার। প্রকৃত সেবারভাবে সবাইকে কাজ করতে হবে। মনোসামাজিক বিবর্তনের স্বাভাবিক আবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে সেবাভাব আপনা-আপনিই জেগে ওঠে। সেবার মনোভাবই কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণে পরিণতি লাভ করবে। জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবসের অঙ্গীকার, দেশ হবে নিরাপদ খাদ্যের সমাহার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত