দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম আকাশছোঁয়া। বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই কিছুদিন পরপর সব জিনিসের দামের এমন ঊর্ধ্বগতি প্রায়ই দেখা যায়। বিশ্বের অনেক দেশে অনাকাক্সিক্ষতভাবে মাঝেমধ্যে ঘটে যাওয়া নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার খবর চোখে পড়ে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও সবকিছু আগের জায়গায় চলে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো কারণ ছাড়াই নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা যায় এবং সেটা একরকম স্থায়ী রূপেই রয়ে যায়। বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ব্যতীত নিম্নগতির কোনো খবর আমাদের দেশে।
বিশেষ করে পূজা, রমজান বা অন্যান্য বড় ধর্মীয় উৎসবের সময় এলেই যেন আরও লাগামহীনভাবে পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যায়, যা নিম্ন আয়ের মানুষদের ক্রয়ক্ষমতার ঊর্ধ্বে চলে যায়।
বাজারে পণ্যের দাম কেন বাড়ে? সাধারণত চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে গেলে বাজারে যেকোনো জিনিসের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুক্তবাজারে যখন যেকোনো পণ্য সহজেই আমদানি করা যায়, তখন দাম বাড়ার কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশে নীতিনৈতিকতা নেই বললেই চলে। সুযোগ পেলেই কোনো না কোনো অজুহাতের কথা বলে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সভ্য দুনিয়ায় খুচরা পর্যায়ের বাজারেও কিছু নিয়মকানুন থাকে। দুর্ভাগ্য, আমাদের তা নেই। ফলে বাজার যখন-তখন চরমভাবে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ এখন দৈনন্দিন বাজারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে রীতিমতো প্রমাদ গুনছে। সবচেয়ে বিপদে আছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
একদিকে আয় কমে যাওয়া, আরেক দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছে না সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে কষ্টে দিন যাচ্ছে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের। সামনে রমজান, তার আগেই নিত্যপণ্যের এমন মূল্যবৃদ্ধি উদ্বিগ্ন করছে সবাইকে।
বাজার পরিস্থিতির উচ্চমূল্যের কারণে গত একবছর ধরে দেশের দরিদ্র, নিম্ন আয়ের এমনকি মধ্যবিত্তরা আছে অসহায় অবস্থায়। এরই মধ্যে আসন্ন রমজান ও ঈদুল ফিতর ঘিরে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা বেড়ে গেছে। আর আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের স্বভাব হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেলেই অন্যান্য পণ্য দ্রব্যাদিরও মূল্য বাড়িয়ে দেয়। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে নজরদারি না থাকায় নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরিস্থিতি যে অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, আগামী রমজান ও ঈদুল ফিতরে এ বাজার সংকট, দেশের বড় অংশ মানুষের জন্য আরও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
পরিস্থিতি যে খুবই খারাপ তার প্রমাণ মেলে টিসিবির ট্রাকের সামনে লাইন দেখে। এবারই প্রথম দেখা যাচ্ছে শহরের চাকরিজীবী পরিবারের গৃহিণী ও অন্যান্য সদস্যকে ট্রাকে লাইন দিতে। অর্থনীতির হিসাবে গড় আয় এবং প্রবৃদ্ধি বাড়লেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষের আয় বাড়েনি, ক্রয়ক্ষমতা বরং হ্রাস পেয়েছে। যেহেতু দ্রব্যমূল্য বাড়তি, টাকার মান কমছে ফলে মানুষের প্রকৃত আয়ও কমতির দিকে। এ অবস্থায় শুধু পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খাচ্ছেন মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষ। করোনাকালে দারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়েছে এবং এখন তাদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। সরকার হতদরিদ্র মানুষদের জন্য ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি করে, যাতে তারা কম মূল্যে পণ্যদ্রব্য ক্রয় করার সুযোগ পায়। কিন্তু কিছু কিছু মধ্যবিত্ত মানুষ আছে এই সুযোগ কাজে লাগায়, তারা কম দামে পণ্য ক্রয় করে বেশি দামের আশায় বাইরে বিক্রি করে দেয়।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারির ভেতরেও কিছু মানুষের ধনী হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকলেও আমার কাছে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে, মানুষের ভোগবিলাসতা ও দেশ-বিদেশে ভ্রমণ বন্ধ থাকা, যার কারণে কোটি টাকার হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে এসব মানুষের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না। যেখানে কোটি টাকার বিষয় জড়িত, সেখানে তাদের কাছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা কোনো বিষয়ই নয়। কিন্তু দেশে যে ৫ কোটির বেশি দরিদ্র মানুষ আছে, তাদের কাছে এ ১০০ থেকে ২০০ টাকার বিষয়টি অনেক উদ্বেগের। সেসঙ্গে দেশের অন্যান্য সব পেশাজীবীর জন্য অনেক বড় উদ্বেগের বিষয়। কেননা, প্রতিমাসে নির্ধারিত আয়ের সঙ্গে যদি বাড়তি ব্যয়, একের পর এক যোগ হতে থাকে, তাহলে তাদের মাস চালাতে হিমশিম খেতে হয়। আর দিনমজুর বা খেঁটে খাওয়া মানুষদের ক্ষেত্রে তো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ভোজ্যতেল হিসাবে সয়াবিন তেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ১০৪ টাকা। সেই সয়াবিন তেল আজ কিনতে হচ্ছে ১৬০ টাকায়। দাম বৃদ্ধির এ হার প্রায় ৫৪ শতাংশ। আরেকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হলো মসুর ডাল। তিন বছর আগে এর দাম ছিল কেজিপ্রতি ৫৫ টাকা। সেই ডাল আজকের বাজারে কিনতে হচ্ছে, কেজিপ্রতি ৯৭ টাকা ৫০ পয়সায়। এর দাম বেড়েছে ৭৭ শতাংশেরও বেশি হারে। মোটা চাল হচ্ছে, আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রধান খাদ্য। তিন বছরে সে চালের দাম ৪০ টাকা থেকে ৫৩ টাকা হয়েছে। দাম বৃদ্ধির এ হার ১৫ শতাংশ। চালের বিকল্প আটা। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আটার দাম ছিল, কেজিপ্রতি ২৮ টাকা ৫০ পয়সা। বর্তমানে বাজারে এর দাম প্রায় ৪৩ টাকার ওপরে। আটার দাম বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ।
এত কিছুর মধ্যে আশার কথা হচ্ছে, সরকার এর মধ্যেই বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের ওপর শুল্কারোপ না করার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দল আর দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ না পায়। শুধু শুল্কারোপ রোধ করে থাকলেই হবে না, অবৈধভাবে কোনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যেন দাম বাড়াতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে দেশের মানুষ দিনের পর দিন সরকারের প্রতি বিরাগ ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে ঘুষ, কালোবাজারি, দুর্নীতি। সমাজের ভেতরে মানুষে মানুষে বাড়বে হানাহানি। বর্তমানে অধিকাংশ মানুষের ভেতরে অসৎ উপায়ে ও স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার প্রবণতা অধিক হারে দেখা যাচ্ছে। আর এ ধনী হওয়ার খেলায় মেতেছে অনেকেই, যার ফলে সমাজে দেখা দিচ্ছে নানান অসংগতি। বৃদ্ধি পাচ্ছে ধনী-গরিবের মধ্যে বিস্তর ফারাক। এ ফারাকের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভবিষ্যৎ আরও খারাপের দিকে যাবে। তাই এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেন কোনো সিন্ডিকেট মহল আর বাড়াতে না পারে, সেদিকে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।