ঢাকা সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক অবিচ্ছেদ্য নাম। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের পথপ্রদর্শক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি। বাঙালি জাতির জন্ম যদিও হয়েছে হাজারো বছর পূর্বে; কিন্তু বাঙালি জাতি হিসেবে কোনো স্বীকৃতি ছিল না, পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে কোনো পরিচিতি ছিল না, বাঙালি জাতির স্বাধীন কোনোও ভূখণ্ডও ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিকে পৃথক জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচিত করেছেন, পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে বাঙালি পরিচিতি পেয়েছে, বাঙালি জাতি রাষ্ট্রও বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে হয়েছে। তাই তো তিনি বাঙালি জাতির পিতা।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম, একটি চেতনা, একটি ইতিহাস।

তার জন্ম না হলে হয়তো বাঙালি জাতি স্বাতীনতা লাভ করত না, সৃষ্টি হতো না স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভেঙে জন্ম হয় দুটি পৃথক রাষ্ট্র- পাকিস্তান ও ভারত। আমাদের এই ভূখণ্ড তথা বর্তমান বাংলাদেশ তখন ছিল পাকিস্তানের একটি অংশ। ব্রিটিশের কবল থেকে স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মধ্যেই এদেশের মানুষ বুঝতে পারে, আমরা নতুন করে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে পড়েছি।

১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করে। তখন থেকেই বাঙালির আত্মজাগরণ ঘটে। আর বাঙালির এই জাগরণকে ধীরে ধীরে ও ধাপে ধাপে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তর সালে স্বাধীনতা শুধু বাঙালির নয়, সমগ্র মানবজাতির হতিহাসে এক অবিনাশী উজ্জ্বল অধ্যায়। আর এই অধ্যায়ের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। আর এই বাংলাদেশ শব্দটি সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৯ সালের ২৯ জুলাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) নারায়ণগঞ্জ মহকুমা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় নারাণয়ঞ্জের ‘বায়তুল আমান’-এ। শেখ মুজিব সেদিন তার বক্তৃতায় পূর্ব পাকিস্তান না বলে ‘বাংলাদেশ’ উচ্চারণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান সশরীরে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে যোগ দিতে পারেননি। কারণ সে সময় তিনি কারাবন্দি ছিলেন।

কিন্তু কারাগার থেকে তিনি চিরকুটের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এবং আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দেন। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্টে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদে এই ভূখণ্ডের ‘পূর্ব বাংলা’ নামের বিরোধিতা করে বলেন, এ অঞ্চলের নাম ‘বেঙ্গল’ অথবা ‘বাংলাদেশ’ করা হোক। ১৯৯৬ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দিবসে আয়োজিত আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন ‘পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধু বাংলাদেশ’।

বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই বাংলাদেশে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গভবনে বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি ১৯৪৭-৪৮ সালে। কিন্তু আমি ২৭ বছর স্টেপ বাই স্টেপ মুভ করেছি।’

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা। বাঙালির মুক্তি সনদ বা ‘ম্যাগনাকার্টা’ বলে কথিত ছয় দফা মূলত ছিল স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা। বঙ্গবন্ধু নিজেই একথা বলেছেন।

একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘৬ দফার মাধ্যমে আমি তোমাদেরকে সাঁকো তৈরি করে দিলাম। তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই পারে (স্বাধীনতা) পৌঁছা।’ ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছরের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘আসন্ন নির্বাচন হবে ছয় দফার প্রশ্নে গণভোট।’ বাস্তবেও তাই ঘটে। জনগণ ছয় দফার পক্ষে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে। এ কারণে নির্বাচনের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা করে। বঙ্গবন্ধুকে তার ছয় দফা থেকে সরে দাঁড়াতে নানা অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনড়, ছয় দফার ভিত্তিতেই দেশ চলবে। আর পাকিস্তানিরা বুঝে নিয়েছিল, ছয় দফা বাস্তবায়ন মানেই বাঙালির স্বাধীনতা।

বঙ্গবন্ধুর অবশেষে ছয় দফার মূল নির্যাস এক দফার ডাক দিলেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে সুস্পষ্টভাবে বললেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইন-শা-আল্লাহ।’ তিনি আরও বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অতঃপর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’। তার স্বাধীনতা ও যুদ্ধ ঘোষণায় বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর বুকে উদিত হয় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির জন্য ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তার রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন এবং দু’বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। পৃথিবীর মানচিত্রে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন বাঙালির ইতিহাস থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবেন অমর-অবিনশ্বর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত