মেট্রোরেল : বাঙালির আরেক স্বপ্ন পূরণ
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও চেয়ারম্যান, বক্ষব্যাধি বিভাগ
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তায়ন হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় স্বদেশ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে উড়ছে। দ্রুত বাস্তবায়ন হচ্ছে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে প্রথম তলদেশ সুড়ঙ্গ বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ ইত্যাদি। এবার উদ্বোধন হলো মেট্রোরেল। এর মাধ্যমে বাঙালির আরেকটি স্বপ্ন পূরণ হলো। ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের শুভ উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের সমগ্র জাতি এই শুভদিনের ও শুভক্ষণের অপেক্ষায় ছিল। এর মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো, বঙ্গবন্ধুকন্যা বিশ্বনেতা শেখ হাসিনা যেমন জাতিকে স্বপ্ন দেখাতে জানেন, তেমনই তিনি জানেন কীভাবে স্বপ্নকে সব বাধা অতিক্রম করে বাস্তবায়ন করতে হয়। মেট্রোরেল চালুর মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে রাজধানীর গণপরিবহনে নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হলো। যানজটের নগরী ঢাকায় যানজট নিরসনে যে বিরাট ভূমিকা রাখবে মেট্রোরেল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর মাধ্যমে নগরবাসীর অর্থ, সময় যেমন সাশ্রয় হবে তেমন যাতায়াতের দুর্ভোগও অনেকটা কমে আসবে। যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেশবাসীর মেট্রোরেল ব্যবস্থা।
উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় নির্মাণাধীন শহরভিত্তিক রেল ব্যবস্থা হচ্ছে ঢাকা মেট্রো যা আনুষ্ঠানিকভাবে মাস র?্যাপিড ট্রানজিট বা সংক্ষেপে এমআরটি নামে পরিচিত। ২০১৩ সালে অতি জনবহুল ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা ও পথের দুঃসহ যানজট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, যার অধীনে প্রথমবারের মতো ঢাকায় মেট্রোরেল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। পরে ২০১৬ সালে প্রণীত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় নির্মিতব্য মেট্রোরেলের লাইনের সংখ্যা ৩টি থেকে বাড়িয়ে ৫টি করা হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন ৬-কে নির্বাচন করা হয়। ২০১৬ সালের ২৬ জুন এমআরটি-৬ প্রকল্পের নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে শুরু হয় ঢাকা মেট্রোর নির্মাণকাজের শুভ সূচনা। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য এমআরটি-৬ নামক ২০.১০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথকে নির্ধারণ করা হয়। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে জাইকা অর্থায়ন করে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দিচ্ছে ৫ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হলে দু’দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। মেট্রোরেলে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কিলোমিটার ৫ টাকা আর সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। এমআরটি-৬ রুটে ১৬টি স্টেশন। সেগুলো হলো- উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, মতিঝিল ও কমলাপুর। দুটি স্টেশনের মধ্যে গড় দূরত্ব হবে ১ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার। বেশি স্টেশন রাখার ফলে বিপুলসংখ্যক যাত্রী এর সুফল ভোগ করবে। ওপরে এবং নিচ থেকে লিফট বা চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে যাত্রীদের ওপরে যাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। ট্রেন চালানোর জন্য ঘণ্টায় দরকার হবে ১৩.৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, যা নেওয়া হচ্ছে জাতীয় গ্রিড থেকে। এর জন্য বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।
মেট্রোরেল চলাচলে আশপাশে যে তীব্র কম্পনের সৃষ্টি হয়, তা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মেট্রোরেলের লাইনের নিচে এমএসএস (ম্যাস স্প্রিং সিস্টেম) রয়েছে। ম্যাস স্প্রিং সিস্টেমে বিশেষ ধরনের বিয়ারিং থাকে, যার কাজ হলো রেললাইনে যে কম্পন তৈরি হয় তা শোষণ করা। এর ফলে ট্রেন চলাচলের সময় আশপাশে তেমন একটা কম্পন অনুভূত হবে না। মেট্রোরেল বিদ্যুৎচালিত। ভিভিভিএফ (ভেরিয়েবল ভোল্টেজ ভেরিয়েবল ফ্রিকোয়েন্সি) ইনভার্টার সিস্টেমে চালিত ট্রেন চলার সময় অনেক কম শব্দ তৈরি করে, যা শব্দদূষণের পর্যায়েও পড়ে না। আবার মেট্রোরেল প্রকল্পটি চালু হলে ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাস ব্যবহারকারী অনেক যাত্রী মেট্রোরেলে যাতায়াত করবে। এর ফলে বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ অনেক কমবে। অন্যদিকে মেট্রোরেল যেহেতু বিদ্যুৎচালিত, তাই বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ নেই বললেই চলে। তাই মেট্রোরেল পরিবহন ব্যবস্থার চাইতে অবশ্যই পরিবেশবান্ধব। জানা গেছে, মেট্রোরেলের চালকের পদটির নাম ‘ট্রেন অপারেটর’। এই পদে ২৫ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। স্টেশন থেকে ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয় করবেন স্টেশন কন্ট্রোলার। এই পদে ৩৪ জন নিয়োগ পেয়েছেন। তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে।
এছাড়া ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর এমআরটি-১ এবং এমআরটি-৫ নামক লাইন দুটির নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এমআরটি-১ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ও নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মোট ৩১.২৪ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এ প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকার দেবে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, বাকি ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা আসবে সরকারি তহবিল থেকে। এমআরটি-১ প্রকল্পে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ২১ কিলোমিটার হবে পাতাল পথে এবং কুড়িল থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে। নতুনবাজার থেকে কুড়িল পর্যন্ত ৩ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রানজিশন লাইনসহ ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এই মেট্রোরেলের ১২টি স্টেশন থাকবে মাটির নিচে এবং ৭টি থাকবে উড়াল সেতুর ওপর। এমআরটি-৫ নির্মাণ প্রকল্পে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পের ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার মধ্যে ২৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা দেবে জাপান আর বাকি ১২ হাজার ১২১ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের মোট ২০ কিলোমিটারের মধ্যে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার হবে পাতাল পথে আর বাকি সাড়ে ৬ কিলোমিটার হবে উড়াল পথে। এ রুটে মোট ১৪টি স্টেশন হবে, যার মধ্যে ৯টি হবে পাতাল আর ৫টি হবে উড়ালপথে।