বিদায় ২০২২। স্বাগতম ২০২৩। নতুন বছরের যাত্রা শুরু হলো। প্রকৃতির এই নিয়মকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারও নেই। কথায় আছে, যায় দিন ভালো যায়। আগামী দিনগুলো কেমন হবে কেউ বলতে পারবে না। তবু এক অনন্ত প্রত্যাশা নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর মানব জাতি। গত বছরটি কেমন ছিল কেমনভাবে আমরা দিন অতিক্রম করেছি, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ না করলেও অনেক কিছ্ইু মনে দাগ কাটবে দীর্ঘদিন। তাই কবি বলেছেন, ‘হে অতীত তুমি ভূবনে ভূবনে কাঁদাও গোপনে’। অতীত মনে করে কোনো লাভ নেই, কিন্তু অতীত যে মানুষের মনে আনন্দণ্ডবেদনার জোয়ার তুলে সেটা কী ভুলতে পারি। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর ভবিষ্যৎ রচনার দিকে মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয় হলেও আমরা অনেকেই অতীত ভুলে যাই সহজে। ২০২২ সালে কত কিছু ঘটে গেছে এই পৃথিবীতে। অনেক কিছুই আমাদের মনে থাকবে না, মনে থাকে না। এই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ঘটনা বহুল কিছু ঘটনা তুলে ধরে নতুন বছরের স্বপ্ন যাত্রায় শরীক হওয়ার প্রত্যাশা করছি।
রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২০২২ সালে সফলতা ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই পার করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফল, আবার কোনো কোনো জায়গায় ব্যর্থতা। সফলতা ব্যর্থতা নিয়েই তো জীবন! একটি রাষ্ট্রেরও তেমনি সফলতা ব্যর্থতা থাকবে। ব্যর্থতা না থাকলে সফলতা আসে না। চরম ব্যর্থতা পরম সফলতার ভিত তৈরি করে। রাজনীতির কথায় আগে আসি। কেননা, একটা দেশের রাজনীতির ওপরই নির্ভর করে সবকিছু। ২০২২ সাল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় দফার ৪র্থ বর্ষ। নিয়মানুযায়ী আর ১ বছর মেয়াদ আছে এই সরকারের। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছেন দীর্ঘদিন। একটা দেশের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার নজির খুব কম দেশেই আছে। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। বিস্ময়কর উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি সামনে তুলে ধরে সরকারি দলের নেতারা প্রচার চালাচ্ছে আগামীতে যাতে ক্ষমতায় আসতে পারে। অন্যদিকে বিরোধীদল যারা দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে তারা ব্যাপকভাবে সরকারের সমালোচনায় মুখর। গণতন্ত্রে সরকারের সমালোচনা হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিরোধীদলের সমালোচনা হতে হবে গঠনমূলক যৌক্তিক। আমাদের দেশে সেটা তেমন হয় না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অনেক সফলতা রয়েছে। বিস্ময়কর এ সফলতার মধ্যে দুটো বড় স্বপ্নের বাস্তবায়ন। একটি হচ্ছে পদ্মা সেতু নির্মাণ অন্যটি মেট্রোরেল। আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দুটো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন ঘটেছে ২০২২ সালে। এ ছাড়াও কর্ণফুলি বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ কাজও সমাপ্ত হয়েছে ২০২২ সালে। দেশব্যাপী এবং বিশ্বব্যাপী মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতু নির্মাণ আলোচনার শীর্ষে। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক জোিেটর কাছে সরকারের কোনো সফলতাই চোখে পড়ে না বলে সরকারি দল মন্তব্য করে আসছে। ২০২২ সাল যখন শুরু হয়, তখন থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যদিও আমাদের দেশে কখনও রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল ছিল না। স্থিতিশীল না থাকবার মূল কারণ হচ্ছে পরস্পর বিপরীতমুখী আদর্শের কারণে। এখানে প্রধান দুটো দল হচ্ছে- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। একটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল (আওয়ামী লীগ) অন্যটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার পর পটপরিবর্তন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে গঠিত দল (বিএনপি)। মনে করা হয়ে থাকে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে না। এর সুস্পষ্ট কিছু প্রমাণও রয়েছে। এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না। আজও বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আমাদের জাতির পিতাকে স্বীকার করে না। সমস্যাটা এখানেই। জাতির পিতাকে অস্বীকার করার অর্থই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা। তারপরও বিএনপির কোটি কোটি সমর্থক রয়েছে এ দেশে। কেন এমন হলো? আগামীতে এই মৌলিক কারণটি খোঁজে বের করতে হবে। রাজনীতিতে বিপরীতমুখী দল থাকবেই; কিন্তু জাতির পিতা নিয়ে কেন বিতর্ক থাকবে? এই প্রশ্নের সমাধান হওয়া দরকার। তা না হলে বাংলাদেশের রাজনীতি কোনো দিনই স্থিতিশীল হবে না হতে পারে না। সহিষ্ণুতাও তৈরি হবে না। বিএনপি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনঢ় এক সময় তারা তত্ত্বাবধায়ক অস্বীকার করেছে। তবে এ দাবিটি আওয়ামী লীগও করেছিল তারা, তা আদায় করেই ক্ষমতায়ও এসেছিল। এখন সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক প্রথা বাতিল করা হয়েছে। কেননা, তত্ত্বাবধায়ক প্রথা অসাংবিধানিক। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে আওয়ামী লীগ কেন তত্ত্বাবধায়ক চেয়েছিল, তখন কী এটা অসংবিধানিক ছিল না? তখনও অসাংবিধানিক ছিল। আওয়ামী লীগ সেটাকে জনতার দাবিতে পরিণত করতে পেরেছিল। জনতার দাবির কাছে সবকিছুই তুচ্ছ, দাবিটিই মুখ্য। বর্তমানে আওয়ামী লীগ তার সুবিধার কথা মাথায় রেখেই রাজনীতি করবে বিএনপি বা অন্যান্য দলও তাই করবে। এই রাজনীতিতে জয়ী হওয়াটাই আসল কথা।
২০২২ সালে অর্থনীতির মন্দার বছর হিসেবে চিহ্নিত বিশ্বজুড়ে। এর আগে কোভিড-১৯ এর আঘাত পরবর্তী সময়ে যোগ হয়েছে- রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। কোভিডকালীন অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা বিশ্ব বিবেচনায় সফল হয়েছি। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কিছুটা নাজুক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে পার করেছি ২০২২ সাল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবন অনেকটা বিপর্যস্ত, হিমশিমগ্রস্ত। পৃথিবী ব্যাপীই মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। এখন বলা হচ্ছে ২০২৩ সাল হবে অধিকতর দুর্যোগের বছর। সারাবিশ্ব খ্যাদ্যাভাব দেখা দেবে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা থেকে এমন আভাসই দেয়া হয়েছে। এরইমধ্যে মানুষ আতঙ্কিত এ খবরে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়েছেন, সাশ্রয়ী হবারও আহ্বান জানিয়েছেন। ২০২২ সালের আরেকটি অভূতপূর্ব ঘটনা বিশ্বকাপ ফুটবল। ২০ নভেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বকাপের উত্তেজনায় ছিল বিশ্বমানব। ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ইতিহাসের নায়ক লিউনেল মেসি। ফ্রান্সের তরুণ ফুটবলার এমবাপ্পেও বিশ্বকাপের বিস্ময়কর ফুটবলার হিসেবে ফুটবলপ্রেমিদের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে। হতাশা, শান্তি ও প্রশান্তির সমন্বয়ের বছর হিসেবে ২০২২ সাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে। গত বছরে তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে, যেমন আবার সুকুমার অভিজ্ঞতাও তৈরি হয়েছে। এই অভিজ্ঞতার ফলে আমাদের চোখ খুলে যাবে নতুন বছরে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের ৫২ বছরে পা দিয়েছি আমরা। এ থেকে ইতিহাসের শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করা উচিৎ। যেসব দুর্বলতা গত বছর গ্রাস করেছে, যেসব সমস্যা রাষ্ট্র দেহ কিছুটা বিপর্যস্ত, সে সবের উৎস কিন্তু একটাই। তা হচ্ছে এই বাংলাদেশের মানুষ নিজেরাই নিজেদের অপদস্থ অপমনা করছি। মানুষ হিসেবে নিজেদের মর্যাদা ও মূল্যকে আমরা অনুভব করতে পারছি না। আমাদের স্বদেশবাসীর মর্যাদা ও মূল্যকে যদি স্বীকৃতি দিতে না পারি, তবে ২০২৩ সালে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না। আমাদের এমন একটি শিক্ষার দিকে নজর দিতে হবে যে শিক্ষা মানব মনকে পরিশালিত করে। বস্তুত জাতি গঠনের এটিই একমাত্র ভিত্তি। জাতীর জীবনকে উন্নত করার একমাত্র শিক্ষা হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ। বিচিত্র উপাদানে গঠিত আমাদের এ বাঙালি সমাজের পেছনে রয়েছে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। এই সমাজকে আধুনিক মহান জাতিতে রূপান্তরিত করা খুব সহজ কাজ নয়। সে জন্য প্রয়োজন নতুন ধরনের, নতুন ভাবের মানুষ। যাদের হৃদয়ে গভীর আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়না এবং প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি দ্বারা গঠিত। উচ্চভাব ও উচ্চ আদর্শকে কাজে পরিণত করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে এগিয়ে যেতে হবে। নতুন বছর নতুন শিক্ষায় মনোযোগী হতে হবে। আমরা যে ধর্ম করি এটা নিয়েও ভাবতে হবে। ধর্ম এখন নিষ্প্রাণ ও তামসার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আমাদের দরকার সৎ চরিত্র, কোটি কোটি মানুষের দ্বারা যে ধরনের ধর্ম অণুসৃত ও আচরিত হচ্ছে, তার বাহ্যিক আড়ম্বরের পেছনে লুকিয়ে আছে চূড়ান্ত স্বার্থপরতা, অন্যের দুঃখণ্ডকষ্টের প্রতি সামাজিক উদাসীনতা এবং হিংসা। যার ফলে আমাদের ইতিহাস বিকৃত, জাতীয় উন্নতি বিলম্বিত এবং জাতীয় উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নে বাধা হয়ে উঠছে। দীর্ঘকাল যাবত বাংলাদেশের মানুষের ধর্ম এই আড়ম্বর ও আচার সর্বস্ব জাগতিকতার রূপ পরিগ্রহ করছে। এ থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। লোভ-লালসা পরিত্যাগ করে নতুন বছরে প্রত্যয়দীপ্ত মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। যে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সূচনা হয়েছিল তার স্থায়িত্ব নিয়ে সব বিষয়ে ভাবতে হবে। অতএব, যে বিষয়ে এই নতুন বছরে সর্বাধিক দৃষ্টি দেয়া দরকার, সেটি হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সুসম্পর্ক প্রবল ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ত্ববোধ। তবেই সবার সুখ ও সমৃদ্ধ নিশ্চিত হতে পারে।