শিক্ষাদীক্ষা

ইংরেজি শেখা, প্রবাসী আয় এবং আমাদের প্রচেষ্টা

মাছুম বিল্লাহ, প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব), [email protected]

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাঙালি, যারা আপনার আমার ভাই-বোন দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, তাদের বিদেশে পাড়ি জমানোর বিষয়টি সুখকর নয়, সেটি শ্রমিক, দক্ষ কারিগর কিংবা উচ্চ শিক্ষা বা উচ্চ চাকরি যে জন্যই তারা বিদেশে অবস্থান করছেন, কোনো ক্ষেত্রেই সুখকর অভিজ্ঞতা নেই, আছে শুধু হয়রানি, বঞ্চনা, ধিক্কার এমনকি জীবননাশের মতো করুণ অবস্থার ইতিহাস। পাসপোর্ট করা থেকে শুরু করে বিদেশের মাটিতে পা ফেলা পর্যন্ত পুরো পথই বাধা, ধক্কি-ঝামেলা, চ্যালেঞ্জ আর হুমকির মুখোমুখি হতে হয়। এ অবস্থা দিন যত যাচ্ছে, তত বাড়ছে। আমরা আশা করে থাকি যে, এ অবস্থার অবসান হয়তো হবে না; কিন্তু অনেকটা সহজতর হবে; কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। দেশের বাইরে প্রকৃত অর্থে কত বাংলাদেশি কাজ করছেন, তার হিসাব নেই, তবে সরকারি হিসাব বললে এ সংখ্যা ১ কোটি ৩২ লাখ এবং বিশ্বের ১৬৮টি দেশেই তাদের অবস্থান। এদের মধ্যে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি যারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। আমরা তাদের নাম দিয়েছি ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’। এই নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তাদের আর কোনো স্বীকৃতি কিংবা উপকারে আমরা আসছি কী কোনোভাবে? আইনকানুন দেখিয়ে তাদের হয়রানি করার ক্ষেত্রে কেউ পিছিয়ে নেই।

উচ্চ শিক্ষা বা অন্য যে কোনো কাজসহ যে কোনো শ্রমবাজারে ইংরেজির দক্ষতা অতিরিক্ত এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। কোনো পেশায় পারদর্শী হলেও সেটি অন্যদের বোঝানোর জন্য ইংরেজির দক্ষতা থাকতে হয়। আর ইংরেজির দক্ষতা বলতে আমাদের স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে যে মেসেজটি প্রচলিত তা হচ্ছে ইংরেজি গ্রামারের নিয়ম জানতে হবে, যত বেশি জানা যাবে- ধরা হয় তিনি তত বেশি ইংরেজি জানেন বলে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। আসলে ইংরেজি একজন বলছেন, আপনি সেটি বুঝে উত্তর দিতে পারছে না কি-না অর্থাৎ আপনার লিসেনিং ক্যাপাসিটি কতটা উন্নত এবং স্পিকিং-এ কতটা পারদর্শী। এ দুটোতে বাংলাদেশি গ্র্যাজুয়েটরা একেবারেই পিছিয়ে। তাদের রয়েছে অপার সম্ভাবনা, মেধা, সাহস ও শক্তি, যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর যোগ্যতা; কিন্তু ভুল পদ্ধতির কারণে তারা ইংরেজির বিষয় দুটোতে (লিসেনিং এবং স্পিকিং) একেবারেই পিছিয়ে। ফেইসবুক ও ইউটিউব খুললে দেখা যায়, অনেকেই ইংরেজি শেখানোর দায়িত্ব নিচ্ছেন এবং সেটি ফলাও করে প্রচার করছেন বাংলায়। বোঝাই যাচ্ছে কি ইংরেজি তারা শেখাচ্ছেন। শুধু ভালো ইংরেজিতে কমিউনিকেট করার কারণে বাংলাদেশিদের তুলনায় ভারত, ফিলিপাইনস ও শ্রীলঙ্কার কর্মীদের বেতন দ্বিগুণ বা তার চেয়েও বেশি। এরপরেও এই ভাষায় আমাদের শিক্ষার্থী ও বিদেশগামীদের দক্ষ করার প্রকৃতঅর্থে কোনো প্রচেষ্টা নেই। সরকার ইংরেজি একটি বাধ্যতমূলক ভাষা স্কুল-কলেজে চালু করেই খালাস। কে করাবেন, কীভাবে পড়াবেন ইংরেজি, সে বিষয়ে কোনো সত্যিকারের গাইডলাইন নেই।

যাদের হাতে ইংরেজি শেখানোর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, তাদের কে পড়াবেন? আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কীভাবে ইংরেজি পড়াতে হবে, কীভাবে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত দক্ষতা বাড়াতে হবে সেই ধারণাই তাদের থাকার কথা নয় এবং নেইও। একটি সময় ছিল যখন গ্রামার ও ট্রান্সলেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ইংরেজি জানা ও ইংরেজি পড়ানো। বিষয়টি আর সেখানে নেই, সেই বিষয় লাখ লাখ শিক্ষকদের কে বোঝাবেন। ইংরেজি শিক্ষকদের যে পরিচিতি থাকতে হবে এ ওয়ান এ টু, বি ওয়ান বি টু, সি ওয়ান সি টু অর্থাৎ কমন ইউরোপীয়ান ফ্রেমওয়ার্ক অব রেফারেন্স যেটি নির্ধারণ করে যার মাতৃভাষা ইংরেজি নয়, তার ইংরেজি দক্ষতা কোনো লেভেলে আছে। ‘এ’ ওয়ান হচ্ছে একেবারে প্রাথমিক লেভেলের যেখানে একজন ব্যক্তি যার মাতৃভাষা ইংরেজি নয় অথচ তিনি তার সম্পর্কে তার বাড়িঘর সম্পর্কে, তার পেশা সম্পর্কে ইংরেজিতে মুখে বর্ণনা করতে পারবেন, লিখতে পারবেন।’ ‘এ’ ওয়ান কিংবা ’এ’ টু-এর কথাই যদি বিবেচনা করি, তাহলে আমাদের যারা ইংরেজি পড়াচ্ছেন তাদের অবস্থান কোথায় সেটি তাদেরই বিবেচনা করতে হবে। সর্বোচ্চ পর্যায় হচ্ছে ‘সি’ টু অর্থাৎ যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি তাদের মতো ইংরেজি পারা (শোনা, বলা, পড়া ও লেখায়)। তারপরে ইংরেজির ওপর যে, আন্তর্জাতিক পরীক্ষা সেটির নাম হচ্ছে- আইইএলটিএস (ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টেস্টিং সিস্টেম)। এখানেও চারটি স্কীলের ওপর পরীক্ষা হয়- লিসেনিং, স্পির্কি, রিডিং ও রাইটিং। এখানও সর্বোচ্চ স্কোর হচ্ছে ৯। ৯ স্কোর করার মানে হচ্ছে ন্যাটিভ স্পিকারের মতো ইংরেজি ব্যবহার করতে পারার মতো দক্ষতা অর্জন করা। এই পরীক্ষায় ৭.৫, ৮ ও ৮.৫ ও খুব ভালো স্কোর। এই স্কোর অর্জন করতে হলে আমাদের যেতে হবে বহুদূর। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেভাবে ইংরেজি পড়াচ্ছি তা দিয়ে এসব স্কোরের ধারে কাছেও যাওয়া যাচ্ছে না কারণ অমাদের পড়ানোর পদ্ধতিই আলাদা। ইংরেজি পড়া ও পড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের ধারণাই ভিন্ন।

দেশে ইংরেজির অবস্থা উন্নয়নের জন্য মাঝেমধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কিংবা সরকারি কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। এখানে যে বিষয়টি ঘটে তা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক শিক্ষক ব্যতীত অনেকেরই ইংরেজির বাস্তবতা, স্কুল-কলেজে ইংরেজির সিলবাস, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবস্থা সম্পর্কে তাদের বাস্তব জ্ঞান নেই। তারা আনুমানিক কিছু কথা বলে থাকেন। এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও দেখেছি, যারা এখনও ভালোভাবে জানেন না যে, বাংলাদেশের প্রাইমারি কোন শ্রেণি পর্যন্ত এবং সেখানে ইংরেজি পড়ানো হয় কি-না, পড়ালে কী কী পড়ানো হয়। এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখে শুনেছি- তারা বলছেন, দেশে বোর্ডের পরীক্ষাগুলোতে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি প্রায় সবাই ফেল করছে। অথচ, ইংরেজিতে বোর্ড পরীক্ষা পাসের হার প্রায় শতভাগ ছুঁই ছুঁই (কিন্তু তারা ইংরেজি জানছে না, ব্যবহার করতে পারছে না যেটি হচ্ছে বাস্তবতা।) কিছু কিছু শিক্ষক আছেন, যারা গাছের উপরে অবস্থান করছেন, নিচের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। অনেকে আছেন শুধু শেক্সপিয়র আর বায়রন নিয়ে ব্যস্ত, ইংরেজি ভাষাা শেখা বা শেখানোর ব্যাপারে তাদের তেমন কোনো বক্তব্য নেই। আবার কেউ কেউ আছেন ল্যাংগুয়েজের কঠিন কোনো একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করা নিয়ে ব্যস্ত, ফলে বাস্তবে যাদের ভাষাটি বাণিজ্যিক কারণে জানা দরকার, খুব দ্রুত জানা দরকার, ব্যক্তি জীবনে ইংরেজি ব্যবহার কীভাবে করবে- সেটি জানা দরকার, এসব বিষয়ের ধারের কাছে তারা নেই। তারা নিজেদের পদোন্নতি কিংবা বিদেশে কোনো লাভের কারণে দু-একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন, যা জনসমপেক্ষ প্রকাশ হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। জার্নালের পাতায় তা আটকা থাকে। ফলে এই জাতীয় শিক্ষকরা বিশাল জনগোষ্ঠীর ইংরেজি উন্নয়নে খুব একটা অবদান রাখতে পারছেন তা বলা যাবে না। এই সুযোগে ইংরেজি শেখানোর তথাকথিত কিছু কোচিং সেন্টার দায়িত্বটি হাতে নিয়ে অর্থ উপার্জন করছে। তাদের সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টেস্টিং সিস্টেম (আইইএলটিএস) কিংবা টোফেলের সম্পর্কে নেই কিংবা সেই আদলে তারা ইংরেজি শেখাচ্ছেনও না।

পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অ্যাডুকেশন ফার্স্ট (ইএফ)। সংস্থাটির সমীক্ষায় ফিলিপাইন ইংরেজি দক্ষতায় উচ্চ অবস্থানে রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই ফিলিপাইনসের শিক্ষার্থীরা সাবলীলভাবে ইংরেজি বলতে পারে। আর আমরা শেখাই পাটংস অব স্পি কত প্রকার ও কী কী, কীভাবে অ্যাকটিভ ভয়েসকে প্যাসিফ ভয়েসে রূপান্তর করতে হয়, সেসব জটিল নিয়ম। কোনটি প্যাসিফ ইত্যাদি। ব্যক্তিজীবনে অ্যাকটিভ বা প্যাসিফ কোথায় হয়, সেগুলো ব্যবহার করে নিজে ইংরেজি বলা বা লেখা হচ্ছে না। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা স্কুল জীবনে হয়তো এগুলো জেনে গেছেন যে, ন্যারেশন কত প্রকার ও কি কি, কীভাবে ডাইরেক্ট স্পেসকে ইনডাইরেক্ট করতে হয়, কমপ্লেক্স বাক্য বাকে বলে, কম্পাউন্ড বাক্য কাকে বলে; কিন্তু এগুলো নিজে ব্যবহার করে ইংরেজি বলা বা লেখার ক্ষেত্রে তাদের তেমন কোনো দক্ষতা অর্জিত হয়নি। ফলে তারা অন্যান্য দেশের শ্রমিক বা অন্য পেশায় নিয়োজিতদের মতো ইংরেজি ব্যবহার করতে পারছেন না। ব্যক্তিগতভাবে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আর বৃহত্তর অর্থে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

অর্থনীতি ফোরামের হিসাবে পৃথিবীতে ইংরেজি ভাষায় কথা বলেন ১৫০ কোটি মানুষ। কিন্তু তাদের মধ্যে ৪০ কোটির মতো মানুষের মাতৃভাষা ইংরেজি, বাকিরা অন্য ভাষাভাষীর লোক। তারা প্রয়োজনে ইংরেজি শিখেছেন এবং ব্যক্তি ও কর্মজীবনে সেটি ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ ইংরেজি দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে যে হারে ব্যবহৃত হচ্ছে, অন্য কোনো ভাষা কিন্তু সে হারের ধারে কাছেও ব্যবহৃত হচ্ছে না। বিবিসির ২৬ আগস্ট ২০২০ সালের প্রতিবেদন বলছে যে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত ইংরেজি দুর্দান্ত প্রতাপের সঙ্গে বিশ্বময় ব্যবহৃত হবে। তারপর হয়তো অন্য কোনো ভাষা এ জায়গা দখল করার চেষ্টা করবে। আমরা যদি ২০৫০ সাল পর্যন্তই ধরি, তাহলেও বলা যায়, ইংরেজি আমাদের শিখতে হবে, আগামী আরও ৩০ বছর।

ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব) এমন একটি সংগঠন, যেটি ইংরেজি ভাষাকে সবার কাছে জনপ্রিয় করার, সহজে ইংরেজি শেখানোর, শিক্ষার্থীদের আনন্দের মাধ্যমে ইংরেজি শেখানো ও শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এটি কোনো দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগঠন নয়। সংগঠনটি ইংরেজি শেখা ও শেখানোর বিভিন্ন আধুনিক কৌশল নিয়ে আলোচনা, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, নিয়মিত অনলাইন ও অফলাইন প্রোগ্রাম আয়োজন করে যাচ্ছে, যাতে সব স্তরের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বিদেশিগামী, বিদেশে যেতে ইচ্ছুক সবারই কাজে লাগে। যে কোনো ভাষা শিক্ষা প্র্যাকটিসের ব্যাপার, এটি শুধু নিয়মকানুন জানা বা পরীক্ষায় পাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইংরেজি আমাদের শিখতে হবে ব্যক্তি উন্নয়নের জন্য, পারিবারিক, সামাজিক এবং জাতীয় উন্নয়নের জন্য।