শ্রদ্ধা

পেলে : ফুটবলের একজন সুপারম্যাসিভ ব্লাকহোল 

খালিদ ফেরদৌস, শিক্ষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ফুটবলের মহানক্ষত্র এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো ওরফে পেলে (১৯৪০-২০২২) ৮২ বছর বয়সে ব্রাজিলের একটা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তার মৃত্যু নিয়ে এর আগেও কয়েকবার গুজব ছড়িয়েছিল। কাতার বিশ্বকাপ চলাকালীন তিনি বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে দু’চারটে কথাও বলেছিলেন। তবে আবার শারীরিক অবস্থা অবনতিতে অনেকে তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে খুব বেশি আশ্চর্য হননি। এটা যেন অনুমতিই ছিল। তবে তিনি চলে যাওয়ার পর যে শূন্যতা, তা নিশ্চিতভাবে অননুমেয়। কারণ এই শূন্য কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। তাই এ মৃত্যু, এ শূন্যতা মেনে নেয়া বড্ড বেশি যন্ত্রণাদায়ক। তবে মানুষের সর্বশেষ গোল তো মৃত্যুই। মৃত্যু মেনে নিতেই যেন বেঁচে থাকে মানুষ! 
পেলে বা কালোমানিক মারা গেছেন-  এ সংবাদের বয়স এরই মধ্যে কয়েক মিলিয়ন-বিলিয়ন মুহূর্ত পেরিয়ে গেছে। প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি ক্ষণে তাকে নিয়ে রচিত হয়েছে স্তূতি, শ্রদ্ধা ও অগাধ ভালোবাসা; যার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এখন ফুটবলের রাজা ও কিংবদন্তি পেলের আত্মা তার দেহ থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তিনি কী আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন? সুস্পষ্ট উত্তরটি-  না। তিনি মারা গেছেন; কিন্তু আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নেননি। এমন মহানায়কের বিদায় হয় না। তারা সবসময় মানুষের মাঝে তাদের কর্ম ও প্রজ্ঞা দিয়ে বেঁচে থাকেন। ফুটবলের সম্রাট পেলে ব্রাজিলের হয়ে ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ব্রাজিলের জার্সি গায়ে সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও তিনবার বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র ফুটবল খেলোয়াড়। এই ফুটবলার তার দুটো জাদুকরী পা দিয়ে দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন। তার অতিমানবীয় খেলা দেখলে বাস্তব বলে মনে হয় না। মনে হয় সে জাদু করে সবাইকে বিমোহিত করছে। তার ঈশ্বরপ্রদত্ত পা দিয়ে সবুজ মাঠে শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকতেন ভ্যানগগ-পিকাসোর শিল্পকর্ম, লিখতেন অভাবনীয় সাফল্যের স্বরলিপি। তিনি এমন একজন ফুটবলার যে ব্রাজিলের ফুটবল সংস্কৃতি পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। ব্রাজিল যে বিশ্বে ফুটবল পরাশক্তি তা তার হাত ধরেই। বিশ্বের নামি-দামি ক্লাবে যে ব্রাজিলের ফুটবলারদের আধিপত্য তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তিনি। ব্রাজিল যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে ফুটবল দিয়ে, তা তিনিই বেগবান করেছিলেন। তিনি শুধু ক্রীড়াঙ্গন নয়, জীবনের নানাক্ষেত্রে তার প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইয়ে তাকে নিয়ে নিবন্ধে তার একটা উক্তি ছিল এমন, ‘অন্যের অনুকরণ না নিজের স্বকীয়তা অর্জন কর।’ এই কথা তরুণদের সফলতার অমিয়বাণীর মতো। 
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, আস্তে আস্তে বিশ্ব ফুটবল খোলনলচে বদলে যাচ্ছে। পেলের শ্রেষ্ঠত্বে জোরেশোরে চিড় ধরিয়েছেন ম্যারাডোনা, মেসি, রোনাল্ডোরা। নানা বিবেচনায় কেউ কারও চেয়ে কম নয়। নতুনভাবে নতুন কালোমানিক হয়ে উঠতে মরিয়া ফরাসি তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে! ফুটবল অঙ্গনে কে সর্বকালের সেরা ফুটবলার এ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। প্রায় শতাব্দীব্যাপী চলছে এই শ্রেষ্ঠত্বের স্নায়ুযুদ্ধ। তবে এ নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও; অনেকে পেলেকেই সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে মনে করেন। তার নিষ্ক্রীয়মনে ফুটবল দুনিয়া ভীষণভাবে নিষ্প্রভ হয়ে গেল।
আরও এক ফুটবল ঈশ্বর দিয়াগো ম্যারাডোনা পেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আমরা স্বর্গে গিয়ে একসঙ্গে ফুটবল খেলব।’ আমরা আশাকরি পেলে স্বর্গে গেছেন! সেখানে তিনি অবশ্যই ম্যারাডোনার সঙ্গে ফুটবল খেলবেন! পর্তুগিজ তারকা রোনালদো পেলের মৃত্যুতে লিখেছেন, ‘তুমি সবসময় ফুটবলের রাজা।’ অসংখ্য ফুটবল লিজেন্ড তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। লিওনেল মেসি লিখেছেন, ‘শান্তিতে বিশ্রাম নাও পেলে।’ ব্রাজিলের ফুটবল লিজেন্ড রোমারিও মনে করেন, পেলের মৃত্যুতে ব্রাজিল তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারিয়েছে। এক এক করে এইভাবে মহাতারকার বিদায় ঘণ্টা বেজে যায়। চলে যেতে হয় ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে সুরলোকে। তাই কবি জীবনানন্দ দাসের ভাষায় সেই অমোঘ সত্য কথাটি বলতে হয়-  ‘প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়।’ কিন্তু কিছু কিছু নক্ষত্র মরে গিয়ে তৈরি করে প্রভাব বলয়ের ব্লাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। যাকে অনুসরণ বা কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে লাখো-কোটি গ্রহ-উপগ্রহ, তারা-নক্ষত্র বা অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তু। বিশাল আকারের নক্ষত্র যদি নিঃশেষ হয়ে যায়; তবে তা থেকে সৃষ্টি হয় সুপার ম্যাসিভ ব্লাকহোল। যাকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে মিলিয়ন-বিলিয়ন গ্রহ-নক্ষত্র। যাকে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছে-  গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ। যেমন-  মিল্কিওয়ে (আমাদের এই ছায়াপথে বাস), এন্ড্রোমিডা ইত্যাদি। তাই ফুটবল নক্ষত্র পেলে মরে গেলেও তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে সুপার ম্যাসিভ ফুটবল ব্লাকহোল। যাকে অনুসরণ করে তৈরি হবে বিশ্বসেরা ফুটবল তারকা বা সফল ব্যক্তি। সর্বোত্তভাবে লাখো-কোটি ভক্তের ইচ্ছে-  ওপারে ভালো থাক এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো ওরফে পেলে। পেলে-ম্যারাডোনারা বেঁচে থাক, ফুটবলে মেসি-রোনালদোদের মতো মহাতারকা তৈরির অনুপ্রেরণা হয়ে।