ব্যাংকিং খাত
দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ কতটা সুরক্ষা দেবে?
রেজাউল করিম খোকন, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ভুয়া ও দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেয়ার একের পর এক ঘটনায় দেশের ব্যাংক খাতে সংকট বাড়ছে। এমনিতেই ডলার সংকট, রিজার্ভ কমে যাওয়া, লাগামহীন খেলাপি ঋণ, তারল্যে ঘাটতিসহ নানা সমস্যায় রয়েছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ খাত। এর মধ্যে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণের ঘটনা বেরিয়ে আসছে। বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে এ ধরনের কেলেঙ্কারি আলোচনায় এলেও সম্প্রতি বেসরকারি ব্যাংকেই বাড়ছে এ প্রবণতা। ইসলামি ধারার বেশ কয়েকটি ব্যাংকেও ঘটেছে এমন ঘটনা। ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে পারছে না বেশ কিছু ব্যাংক। শুরুর দিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি সব ব্যাংককেই প্রয়োজন অনুযায়ী ডলার সহায়তা দিচ্ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সংকট তীব্র হওয়ায় বর্তমানে শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য, সার ও জ্বালানি তেল আমদানিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ডলার সহায়তা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মাত্রাতিরিক্ত আমদানি ব্যয়ের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অর্থ পাচারের ঘটনা ধরা পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে। একই সময়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে এলসি জালিয়াতির ঘটনাও ধরা পড়েছে। এর পাশাপাশি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে ঋণ বিতরণ করার ঘটনাও বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না। উদ্যোক্তাদের একটি অসাধু অংশের পাশাপাশি ব্যাংকাররাও দুর্নীতির চক্রে জড়িয়ে পড়ছেন। ব্যাংকের কিছু পরিচালকের অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এর প্রসার ঘটেছে। ফলে জালজালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এক পর্যায়ে এসব ঋণের গ্রাহকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। পরিণত হচ্ছে বেনামি ঋণে। যাদের অস্তিত্ব মিলছে, তাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় হচ্ছে না। ফলে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপিঋণ। বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ। কমে যাচ্ছে আয়। ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। সব মিলিয়ে দুর্নীতির চক্রে পড়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংক খাত।
ব্যাংক ব্যবস্থায় চার চলকের ওপর ভিত্তি করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলকগুলো হচ্ছে- শ্রেণিকৃত ঋণের মাত্রা, মূলধন পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত এবং প্রভিশনের পরিমাণ। বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, আমরা কোনো ব্যাংক বন্ধের পক্ষে নেই, আমানতকারীর টাকা যেন নিরাপদ থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে চাই। আমরা চাই সব ব্যাংক ব্যবসা করবে, লাভ করবে এবং বাজারে টিকে থাকবে। এ ব্যাংকগুলোর অবস্থার উত্তরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। দ্রুতই সেগুলোকে সবল করার পদক্ষেপ নেয়া হবে। একশ্রেণির আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রেখে মানুষ টাকা ফেরত পাচ্ছেন না, একশ্রেণির দুর্বল ব্যাংকের ক্ষেত্রেও এমন পরিস্থিতি দাঁড়ায় কি-না, সে পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। গভর্নরের এমন বক্তব্যের পর অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অপর্যাপ্ত জামানত, অনিয়মের মাধ্যমে সৃষ্টঋণ, খেলাপিঋণের আধিক্য, আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি দেখানোসহ বিভিন্ন অনিয়ম জেঁকে বসেছে ব্যাংক খাতে। তাই এই উদ্যোগ নিয়েছেন গভর্নর। ব্যাংক খাতের সুরক্ষায় যে কয়টি দুর্বল ব্যাংককে নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক তার মধ্যে ৬টি ব্যাংকই সরকারি। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা, সোনালী, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংকের পাশাপাশি রাষ্ট্র মালিকানাধীন বিশেষায়িত দুই ব্যাংক রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত। অন্য চারটি দুর্বল ব্যাংকের মধ্যে বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং বেসরকারি ৩টি যথাক্রমে ন্যাশনাল, পদ্মা ও এক্সিম ব্যাংক। শ্রেণিকৃত ঋণের মাত্রা, মূলধনের পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত ও প্রভিশনিং বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে এ ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্যাংকে অনেক সময় শ্রেণিকৃত ঋণ অনেক বেশি হয়ে যায়। এগুলো ব্যাংক রিকোভারি করতে পারে না। অনেকক্ষেত্রে মামলা হয়ে থাকে। এসব পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো এমইউ অনুযায়ী কাজ করছে কি-না, সেসব দেখভাল করতেই পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। ব্যাংকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মেনে দেয়া হয়। কিন্তু অনেক সময় এ ঋণগুলো বিতরণ করার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম ওভারলোড করে ফেলে। এক্ষেত্রে যারা পর্যবেক্ষক থাকে, তারা ব্যাংকের অবস্থা সম্পর্কে জানে। তখন তারা ব্যাংকের ঋণ দেয়ার বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে। পর্যবেক্ষকরা বিভিন্নভাবে চিন্তাভাবনা করে বোর্ডের কাছে ঋণ না দেয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করে। বড় ধরনের অনিয়মের আশঙ্কায় ১৯৯৪ সালে প্রথম ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও অনিয়ম ঘটায় ২০০৬ সালে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে এবং প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ২০০৮ সালে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক করা হয়। তবে ব্যাংকটি এখনও আগের মতোই ধুঁকছে। এরপর আরও কয়েকটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়। দেশে ব্যাংক রয়েছে ৬১টি। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ১৪ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক ও নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা এই দায়িত্ব পালন করছেন। তার মানে দেশের এক-চতুর্থাংশ ব্যাংক এখন পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক দিয়ে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ আগ থেকেই অনিয়ম ধরা পড়া ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে আসছে। গত জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যোগ দিয়েই দুর্বল ব্যাংককে পৃথকভাবে তদারকির উদ্যোগ নেন নতুন গভর্নর। এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেছিলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ১০টি দুর্বল ব্যাংককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করা হবে। প্রতিটি ব্যাংকের অগ্রগতি বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যবেক্ষণ করবেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতেই ব্যাংকগুলোতে সমন্বয়ক বসানো শুরু হয়। এরই মধ্যে পাঁচ ব্যাংকে সমন্বয়ক বসানো হয়েছে। ব্যাংক পাঁচটি হলো- এবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। আর আগে থেকেই পর্যবেক্ষক দেয়া আছে- সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে। নতুন করে অনিয়ম ধরা পড়ায় পর্যবেক্ষক বসেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে। এ দুইটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে কিছু অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তারা ঋণ দেয়ায় নিয়ম মানেনি। গ্রাহকরা আমানতের টাকা তুলে নিচ্ছিলেন। ব্যাংক দুইটিকে নিয়মের মধ্যে রাখা এবং গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতেই পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থিত থেকে সভায় ব্যাংকের স্বার্থ পরিপন্থি কিছু হলে তারা মতামত দেবেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কী-না, এ বিষয়ে তারা প্রতিবেদন দেবেন। এর বাইরে নানা গুজবে ব্যাংকগুলো চাপে আছে। তাই আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যতদিন মনে করবে, ততদিন ওই দুইটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষকরা কাজ করবেন। ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগের ঘটনা এই প্রথম নয়। ১৯৯৪ সাল থেকে এ ব্যবস্থা চলে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যখন প্রয়োজন মনে করে, তখন ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে বলে জানান তিনি। এর আগেও ইসলামী ব্যাংকে অনিয়ম ও জঙ্গি অর্থায়নের আশঙ্কায় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে, একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ নেয়। আর ২০২০ সালের মার্চে পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নব্বইয়ের দশকে সাতটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়ার পর ওই ব্যাংকগুলো দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠে। ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল রাজনৈতিক প্রভাব, জঙ্গি অর্থায়ন এই বিষয়গুলো দেখতে। সেরকম কিছু না পেয়ে হয়তো পর্যবেক্ষক প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু নতুন পরিচালনা পর্ষদ আসার পর তারা কী করেছে, সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক দেখেনি। এখন সেটা বোঝা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগ না করলেও কোন ব্যাংক কী করছে, সেটা দেখার ক্ষমতা ও দায়িত্ব তাদের। তারা তা দেখেনি। পর্যবেক্ষকও সঠিকভাবে কাজ নাও করতে পারে। তাকে ঠিকমতো কাজ করতে দেয়া নাও হতে পারে। আমরা দেখেছি, একজন পর্যবেক্ষক কাজ করতে না পেরে পদত্যাগ করে চলে গেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক আরেকজন বসিয়ে দিয়েছে। আসল কথা হলো, বাংলদেশ ব্যাংককে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। দায়িত্ব পালন করতে হবে। ছোটখাটো ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করলে হয়তো কাজ হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সরসরি মনিটর করতে পারে। কোনো অনিয়ম হলে তারা তা সরাসরি দেখতে পারে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের মতো বড় এবং প্রভাবশালীদের ব্যাংকে পর্যবেক্ষক কী করবেন! অনেকেরই সুপারিশ ছিল, ইসলামী ব্যাংকসহ একই শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৮টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসক নিয়োগ করা। তাহলে তার স্বাক্ষর ছাড়া কিছু হতো না। কিন্তু তা তো করা হলো না। অনেক নরম ব্যবস্থা নেয়া হলো। আমরা এর আগেও তো দেখেছি পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে কাজ হয়নি। তারা কাজ করতে পারেনি। একটি ব্যাংকের প্রভাবশালী ১৫ জন পরিচালক আর ১০ কর্মকর্তার সামনে পর্যবেক্ষক কি করবেন। তবে প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হলে আলাদা কথা। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সময় দেশের ১৫টি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা ও অন্যান্য ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তা পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে একসঙ্গে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কৃষি ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে পর্যবেক্ষক দেয়া হয়। আইসিবি ব্যাংকে ১৯৯৪ সালে, ন্যাশনাল ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ২০০৪ সালে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকে ২০১৩ সালে, ইসলামী ব্যাংকে ২০১০ সালে, এনআরবি কমার্শিয়াল ও ফারমার্স ব্যাংকে (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ২০১৬ সালে এবং এবি ব্যাংকে ২০১৭ সালে পর্যবেক্ষক বসানো হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালের আগস্টে পর্যবেক্ষক বসানো হয় ওয়ান ব্যাংকে। কিছু কিছু ব্যাংকে নামে-বেনামে নিজেদের মধ্যে ঋণ দেয়া হচ্ছে। আবার এসব ঋণের বিপরীতে যে পরিমাণ জামানত নেয়ার কথা তা নেয়া হয়নি। যে পরিমাণ জামানত নেয়া হয়েছে তার গুণগতমান খুবই দুর্বল। যেমন, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক ঘটনায় বন্ধকী সম্পদ হিসেবে যে পরিমাণ জমি দেখানো হয়েছিল, তার বড় একটি অংশই ছিল সরকারি খাসজমি, ডোবা-নালা। অনেক ঋণই অনিয়মের মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছে। আবার এসব ঋণ বছরের পর বছর পরিশোধ করা হচ্ছে না। ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ঋণ পরিশোধ দেখানো হচ্ছে। এভাবে খেলাপিঋণ আড়াল হয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পরিদর্শনে এমন একটি নতুন প্রজন্মের ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারির তথ্য উঠে এসেছে। নতুন প্রজন্মের অপর একটি ব্যাংক গ্রাহকদের অর্থফেরত দিতে পারছে না। এরই মধ্যে ব্যাংকটি নাম পরিবর্তন করে নতুন নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এসব ব্যাংক দুর্বল। ব্যাংকগুলোর অনিয়মণ্ডদুর্নীতি প্রতিরোধে পর্যবেক্ষক নিয়োগ কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, কিছু ব্যাংকে আগে থেকেই পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক থাকা অবস্থাতেই এসব ব্যাংকে নানা ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটে। পর্যবেক্ষকরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় অংশ নিতেন। এরপর তা নিয়ে মন্তব্য দেয়ারও সুযোগ ছিল। গত কয়েক বছরে যেসব ব্যাংকে বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, সেগুলোকে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুর্বল সব ব্যাংকই ভবিষ্যতে ধাপে ধাপে তদারকির আওতায় আসবে। নিয়োগপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষকরা আগের পর্যবেক্ষকদের থেকেও বেশি ক্ষমতাবান হবেন। ফলে বোর্ডের সিদ্ধান্তে মতামত দিতে পারবেন।
বিভিন্ন ব্যাংকের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ কতটা সুরক্ষা দেবে? অনেক পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক সভায় অংশ নিয়ে সম্মানী নিলেও কোনো ভূমিকা রাখছেন না। সভাগুলোতে যেসব অনিয়ম হচ্ছে, তাণ্ডও তুলে ধরছেন না। এমনকি সভা শেষে কেউ কেউ প্রতিবেদনও জমা দিচ্ছেন না। ফলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। আরও কয়েকটি ব্যাংক দুর্বল হওয়ার তথ্য পরিদর্শনে ধরা পড়ছে। আগে যেসব ব্যাংকে পর্যবেক্ষক দেয়া হয়েছে, সেগুলোরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। ফলে এই মডেল ব্যর্থ হলে পর্ষদ ভেঙে প্রশাসক বসানো ছাড়া উপায় থাকবে না। দেশের বিভিন্ন ‘দুর্বল’ ব্যাংকে দায়িত্ব পাওয়া পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়কদের গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। পর্যবেক্ষকদের সাহসী ও উদ্যোগী হয়ে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য উন্নতিতে ভূমিকা রাখতে এবং ব্যাংকগুলোকে ভালো পর্যায়ে নিতে চেষ্টা করতে হবে। অর্থনীতিতে গভীর সংকট চলছে। কাঠামোগত সমস্যা, সুশাসনের অভাব, সময় মতো সংস্কারের পথে না যাওয়াই এর মূল কারণ। নিম্ন আয়ের মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ধার দেয়া হচ্ছে সমাজের ধনিক শ্রেণির কাছে, যারা তা পরিশোধ করছেন না; আর আর্থিক খাতের কিছু সমস্যা ক্যান্সারের মতো, এগুলো চিহ্নিত করে তা সারানোর উদ্যোগ নিতে হবে। মোটা দাগে দুটি বিষয় সামনে রেখে ব্যাংক খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। একটি হচ্ছে, সমন্বিত সংস্কার; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও এর আওতায় শক্তিশালী হবে। এ জন্য আইনি পরিবেশ এবং এ খাতের তথ্যের অবাধ সরবরাহের নিশ্চয়তা থাকবে। আরেকটি হচ্ছে ব্যাংক কমিশন গঠন; এ কমিশন ব্যাংক খাতের গোড়ার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পথ তুলে ধরবে। প্রায় এক দশক ধরেই ব্যাংক কমিশন গঠনের কথা বলা হচ্ছে। সরকার এর মাঝে উদ্যোগ নিয়েও তা আর গঠন করেনি। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং হাইকোর্ট তদন্তে নেমেছে। ঋণ জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনিয়ম প্রকাশের পর ব্যাংক খাত বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খেলাপি ঋণ যা দেখানো হয়, বাস্তবে তা আরও বেশি। অর্থনীতিবিদরা ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) এ কথা বলে থাকে। খেলাপিঋণ এখন কত, তা সবার মুখস্থ (১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা)। এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যাংকগুলোতে মূলধনের ঘাটতি থেকেই যাবে- সমস্যাও বাড়তে থাকবে। ব্যাংক খাতের দুর্বলতার সঙ্গে কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সম্পর্ক নেই। কারণ, ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই দুর্বল। ব্যাংকের পর্ষদে যে এক পরিবার থেকে অনেক সদস্য থাকার বিধান চালু আছে, তা কমানো দরকার। আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ নির্ণয় করা দরকার আইএমএফের মান অনুযায়ী। প্রতারণা ও জালিয়াতি রোধে ব্যাংকগুলোতে সমন্বিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতিও রাখতে হবে।