মতামত

কৃষিজমি রক্ষা ও উৎপাদন বাড়াতে হবে

গাজী আরিফ মান্নান, শিক্ষক ও কলামিস্ট 

প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

যতই দিন যাচ্ছে কৃষিজমির পরিমাণ কমতে শুরু করেছে, ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ কৃষি শুমারি-২০১৯ সদ্য ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায়, আবাদি জমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। ২০০৮ সালে নিট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার একর। ১১ বছরের ব্যবধানে দেশে আবাদি জমির পরিমাণ কমে গিয়ে ২০১৯ সালের জরিপে দেখা যাচ্ছে ১ কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার একর। নিট আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ৪ লাখ ১৬ হাজার একর। জিডিপিতে কৃষির অবদান কম হলেও গুরুত্ব কম নয়। কৃষি খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। 

প্রতি বছর বিভিন্নভাবে আবাদি জমির পরিমাণ কমতে থাকে। আমন মৌসুম শেষ হওয়ার পরপরই আশঙ্কাজনক হারে কেটে নেয়া হয় কৃষিজমির মাটি।

এ সময়ে কৃষিজমি থেকে দেদারসে মাটি কাটে মাটিখেকো সিন্ডিকেট। দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা বৈধ-অবৈধ ইটভাটার মালিকদের প্রলোভনে পড়ে কিছু জমির মালিক না বুঝে অল্প টাকার লোভে নিজেদের আবাদি জমির মাটি বিক্রি করে দেয়। একসময় এই নিচু জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ায় ফসল উৎপাদন করা মোটেই সম্ভব হয় না, ফলে সেই জমিটি অনাবাদি পড়ে থাকে। এভাবে বছর বছর বাড়তে থাকে অনাবাদি কৃষিজমির পরিমাণ, কমতে থাকে ফসল উৎপাদন।

কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করার প্রবণতা ভয়ংকর। তা হতে পারে কৃষির জন্য বড় ধরনের হুমকির কারণ। ফসলের উৎপাদনে আসতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়। আবাদি জমির উপরিভাগ কেটে ফেলার ক্ষতি প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার মতে, প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে মাটি সবচেয়ে মূল্যবান। জমির উপরিভাগের ৬ থেকে ৭ ইঞ্চির মধ্যেই থাকে সব ধরনের জৈব গুণাগুণ। অথচ এটাই কেটে নেয়া হচ্ছে। ফলে এসব জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। ফসলি জমির টপ সয়েল দেদারসে কাটার ফলে, একদিকে যেমন ধ্বংস হচ্ছে, কৃষিজমি এবং অন্যদিকে জমির কমছে উর্বরতা অন্যদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। একসময় এইসব জমিতে আবাদ করা সম্ভব হয়ে উঠে না, অনাবাদি থেকে যায়। অনেক সময় রাস্তার পাশে আবাদি জমির মধ্যে নতুন নতুন ঘরবাড়ি তৈরি হয়, এতে আবাদি জমির পরিমাণ কমতে থাকে। আবার নতুন করে রাস্তা-ঘাট তৈরি করার জন্য জমির উপর দিয়ে রাস্তা বানানো হয়। বছর বছর আবাদি জমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। 

এভাবে ক্রমাগত কমতে থাকবে আবাদি জমির পরিমাণ, ফলে এক সময় ফসল কম উৎপাদন হবে দেখা দেবে খাদ্য ঘাটতি।

কৃষিকে পেশা হিসেবে নিতে দেশের বেশিরভাগ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। খোদ কৃষকরাও তাদের সন্তানদের এ পেশায় আনতে আগ্রহী নেন। এক সময় দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে জড়িত থাকলেও বর্তমানে ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। নতুন প্রজন্ম ও কৃষকগোষ্ঠীর পরিবার এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় উৎপাদন বাড়ানো জরুরি। সেই লক্ষ্যে চাষাবাদে আগ্রহ বাড়ানোর পাশাপাশি আবাদি জমির পরিমাণও বাড়াতে হবে। এদেশের ইঞ্চি জমির মাটিতেই সোনা ফলাতে হবে, তাহলে একদিন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে আমার দেশ। একজন কৃষকের, একটি আবাদি জমি যেন একটি পরিবারের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়, সেভাবেই কৃষিকে এগিয়ে আনতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে তার ওপর জোর দিয়েছেন। বাড়ির আনাচে-কানাচে যেখানে সম্ভব শাকসবজি বাগান বা বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করার জন্য বলেছেন। প্রয়োজনে কৃষি কর্মকর্তা থেকে সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে উৎপাদন বাড়াতে বলেছেন। আমরা এটাও জানি সরকার মাঝেমধ্যে কৃষকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সাহায্য করে থাকে, যেমন; সার, বীজ, ওষুধ ইত্যাদি কৃষকদের মধ্যে বিলিবণ্টন করে থাকে। এছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সরকারিভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ কৃষকদের দিয়ে থাকে আর্থিক সুবিধাসহ। ভবিষ্যতে আরও বেশি পরিসরে কৃষকদের মধ্যে সহায়তা প্রদান করে কৃষি আবাদে উদ্বুদ্ধকরণ এবং প্রয়োজনীয় কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার উৎসাহিত করতে হবে।

পরিশেষে, কৃষি বাঁচাতে হলে বন্ধ করতে হবে, আবাদি তথা কৃষিজমির মাটি কাটা ও আবাদি জমিতে নতুন ঘরবাড়ি তৈরি। 

এভাবে আবাদি জমি দখল করে কেউ যাতে স্থাপনা নির্মাণ না করতে পারে, সে ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কৃষক ও জনসাধারণকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে, কৃষি হচ্ছে আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এ ব্যাপারে গ্রামের জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য গণমাধ্যম বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে এবং মসজিদে মসজিদে খতিবের মাধ্যমে এ বিষয়ে মুসল্লিদের বলার অনুরোধ করতে হবে, যাতে কৃষিজমির মালিকরা সচেতন হয়। খাদ্য ঘাটতি পূরণ করার জন্য কৃষি জমির গুরুত্ব অনুধাবন করে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, বাঁচাতে হবে কৃষি এবং দেশকে। তেমনিভাবেই কৃষিজমি রক্ষায় ও উৎপাদন বাড়াতে যথাযথ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।