পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে দেশ থেকে ধারদেনা করে, কেউবা চড়া সুদে ঋণ নিয়ে, কেউবা জমিজিরাত বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমান। খুব কমই আছেন, যারা জমানো টাকায় বিদেশে যান। প্রবাসী অর্থ আমাদের অর্থনীতি বলীয়ান রাখতে পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বৈদেশিক মুদ্রা মজুতে রেমিট্যান্স বড় আস্থার জায়গা। সংগত কারণেই প্রবাসী কর্মীরা জাতীয় উন্নতিতে যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ, এজন্য অনেকেই তাদের অর্থনৈতিক যোদ্ধা হিসেবে মান্য করে থাকেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বিভিন্ন সময়ে এসব প্রবাসী কর্মীরা দেশে লাশ হয়ে ফিরে আসেন। কাগজে-কলমে অনেক মৃত্যু স্বাভাবিক বলে প্রত্যায়িত হলেও, প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করা হয় বলে আমাদের জানা নেই। প্রকাশ, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাশ আসে ২ হাজার ৮৪৭ প্রবাসীর। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচ দেশে মৃত্যু হয় ১ হাজার ৯৮৭ জনের। সৌদি আরবেই মারা যান ১ হাজার ১৯৩ জন। তাদের মধ্যে নারীকর্মীও রয়েছেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্রতিকূল পরিবেশ, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের কথা বলা হয়েছে। প্রবাসে অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার এসব শ্রমিকের বেশিরভাগই বয়সের দিক দিয়ে তরুণ। এদিকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও তিন বিমানবন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক দশকে ৩৩ হাজার ৯৯৮ প্রবাসী শ্রমিকের বিদেশে মৃত্যু হয়েছে।
মানুষের জন্মের ধারাবাহিকতায় মৃত্যু একটি স্বাভাবিক ঘটনা। অস্বাভাবিক মৃত্যু কারও কাম্য নয়। প্রবাসীদের মৃত্যুর ঘটনায় এ বিষয়গুলো সামনে আনা উচিত। অর্র্থাৎ এই মৃত্যুগুলোর সবই কি স্বাভাবিক? তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৭৪৫ জন প্রবাসীর লাশ এসেছে। তাদের ২০ দশমিক ১২ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে অপঘাতে। যেসব মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলা হচ্ছে, সেগুলোও সন্দেহমুক্ত নয়। অপমৃত্যুর শিকার কর্মীদের গড় আয়ু অনেক কম। বাংলাদেশে অভিবাসন খাত নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, প্রবাসে মারা যাওয়া শ্রমিকদের বড় একটি অংশের মৃত্যু ঘটে স্ট্রোকে। এরপর রয়েছে হৃদরোগ ও কিডনির সমস্যা। কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু ও সড়ক দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, আগুনে পুড়ে মৃত্যু, আত্মহত্যা বা খুন। অথচ প্রবাসীদের এমন আকস্মিক মৃত্যুর কারণ দেশ থেকে যাচাই করা হয় না। ফলে লাশের সঙ্গে আসা মেডিকেল রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে যা উল্লেখ করা হয়, সেটাই চূড়ান্ত হিসেবে ধরা হয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৭০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে কাজ করেন। বিদেশে চাকরিতে যান সাধারণ ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সিরা। তারা দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হন। কর্মক্লান্তিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন, অনেকে চিকিৎসা পান না। রেমিট্যান্স আহরণকারী কর্মীদের এহেন অবস্থা কিছুতেই মেনে নেয়া যায়।
প্রবাসী কর্মীদের দেখভালের জন্য সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ রয়েছে। আমরা আশা করব এ বিষয়ক সংস্থাগুলো আরও প্রবাসী কর্মীদের প্রতি আরও যত্নবান হবেন। বিশেষ করে তাদের কর্মপরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত দিকগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ করে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন। জানা যায়, বাসাবাড়ির মালিকদের শারীরিক নির্যাতন, যৌন-নির্যাতনসহ নানা কারণে কিছু নারীর মৃত্যু হয়েছে। সংগত কারণেই নারীকর্মীদের সম্মানের বিষয়টি নিয়েও কথা বলতে হবে। সব ধরনের মৃত্যু প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনে সরকারেরও একটি ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন- এটাই প্রত্যাশা।