বিএনপি আসলে কী চায়
নৌকার পালে হাওয়া ধানের শীষে পোকা
কাজী রশীদুল হক পাশা
প্রকাশ : ০৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখন আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। নতুন বছরের শুরু থেকেই তারা যার যার মতো নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করবে। আপাতত এমনটাই মনে হচ্ছে। সব সময়ই নির্বাচনের আগে এমনটাই ঘটে থাকে। তবে গত দুটি নির্বাচনের আগে তেমন প্রস্তুতি ছিল না। ২০১৩ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনটা হয়েছিল অন্যরকম। অন্যরকম নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছিল সরকার এবং এটা করতে বাধ্য করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। তাদের অবৈধ দাবি ও আন্দোলনের ফলে নির্বাচন থেকে তারা ছিটকে পড়ে। সেই ছিটকে পড়া আজও ভুলতে পারেনি তারা। স্বাভাবিক নির্বাচনের দিকে তাদের কোনো মনোযোগ নেই। নির্বাচনের কথা না ভেবে সেই পুরোনো অবৈধ এক দাবি নিয়ে এগোচ্ছে তারা। দাবিটি হলো-এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন তারা করবে না এবং নির্বাচন হতেও দেবে না। দীর্ঘদিন ধরে তারা একই বুলি আওড়াচ্ছে। এই দাবি নিয়ে সারা দেশে সমাবেশ করছে, মিছিল করছে। জনসমাগমও হচ্ছে। এতেই তারা ভাবছে, জনগণ তাদের সঙ্গেই আছে এবং তারা ঠেলে সরকারকে ফেলে দিতে পারবে। রাজনীতিতে এমন ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। আমাদের দেশেও ঘটেছে। এবং তা রাজনীতিতে পরিপক্ব একমাত্র দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। সেই সাফল্যকে সামনে এনে বিরোধীরাও একই চিন্তা করছে যে, তারাও সরকারকে ঠেলে ফেলে তাদের দাবি মানিয়ে নতুন কোনো গঠিত অনির্বাচিত সরকারের অধীনে তারা নির্বাচন করাতে বাধ্য করতে পারবে। সেই নির্বাচনে তারা জিতে ক্ষমতায় বসবে। এখনও তারা এটা করতে পারবে বলে আশাবাদী। এখনও বলছে, এ বছরই এই সরকারের বিদায়ের বছর। যদিও এর আগে বেশ কয়েকবার সরকারের বিদায়ের তারিখ ঠিক করেছিল; কিন্তু বিদায় করতে পারেনি বরং সরকার আরও শক্ত হয়েছে। আর এটা হয়েছে জনগণের জন্য। জনগণ বিএনপির এই আবদারে সায় দেয়নি। বরং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ক্রমেই এই বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। অর্থাৎ বলা যায়, এখন জনগণ থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন হয়েই এক দফার আন্দোলন চালাতে চাচ্ছে।
একদিকে এক দফার আন্দোলনে বিএনপি, অপরদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামনে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ। জনগণ চাচ্ছে নির্বাচনে মাততে। কেননা, আদিকাল থেকেই এদেশে নির্বাচন একটি উৎসব হিসেবে জনগণ গ্রহণ করে। সম্প্রতি একটি কাজে আমাকে চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল। দু’দিন সেখানে থাকার ফলে গ্রামের মানুষের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমার ধারণা আমাকে অভিভূত করেছে। গ্রামের কারও মনে কোনো অভাব, কষ্ট, হতাশা কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না। সবাই বেশ খুশি। সবাই ভালোই আছে। বেশ হাসি-খুশি সবাই। কয়েক দিন আগেই প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে এসেছিলেন। সেই কথার রেশ তখনও ছিল। গ্রামটি মূলত জেলেপল্লি। মাছের ব্যবসাই তাদের মূল আয়ের উৎস। তারা আয় করছে, ব্যয় করছে, কোনো হতাশা নেই। মহাজন, জেলে, সবাই ভালো আছে। এক যুবক, যে নিজেই মহাজন। মহাজন মানে মাছের আড়তের মালিক। জেলেরা মাছ ধরে সেখানে রেখে বিক্রি করে। নিলামে মাছ বিক্রি হয়। সারা বছর এক রকম যায় না। কোনোদিন মাছ বেশি ধরা পড়ে, কোনো দিন কম। এইভাবে কম-বেশি বেচাকেনার মাধ্যমেই চলে সারা বছর। সবাই লাভবান। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের সব গ্রামের অবস্থাই এমন। দারিদ্র্যপীড়িত গ্রাম এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই যদি হয় সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা, তাহলে তারা কেন সরকার পতনের আন্দোলনে যোগ দেবে? এটাই বাস্তবতা এবং এ জন্যই বিএনপির আন্দোলন সফল হচ্ছে না। বিএনপি বিষয়টি বুঝতেও পারছে না। বিএনপি যদি প্রকৃত কোনো রাজনৈতিক দল হতো, তাহলে এটা উপলব্ধি করতে পারত এবং জনগণ কী চায়, সেই দিকে তাদের আন্দোলন চালিত করত। তাতে অবশ্যই জনগণের সমর্থন পেয়ে আন্দোলন এগিয়ে নিতে পারত। কিন্তু তা তারা করেনি। কে বলেছে, কেন বলেছে, কেউ তা জানে না যে, এক দফার আন্দোলন কেন করতে হবে। আর এমন আন্দোলন করা তাদের পক্ষে সম্ভব কি-না, সেটাও বিবেচনা করা হয়নি। আওয়ামী লীগ পেরেছে, তাই তারাও পারবে-এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা এনেছে। আওয়ামী লীগ দেশের সাধারণ মানুষের দল। সবচেয়ে বড় দল এটি। তার ওপর এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দল। তাদের আছে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে আগে বিএনপিকে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে হবে। তারপর আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার কথা চিন্তা করতে পারবে। এসব না ভেবেই হুট করে বলে বসল আওয়ামী লীগ সরকারকে ঠেলে নামাতে হবে এবং কোনো অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে। এদের দাবি এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কোনো অংশ সমর্থন করেছে বলে জানা যায়নি। মাঠে-ময়দানে চিৎকার করে যেমন জনগণকে বোঝাতে পারছে না, ঠিক তেমনি টক শো করেও তাদের দাবি যে যুক্তিসঙ্গত তাও বোঝাতে পারছেন না। আন্দোলনে জনসমর্থন কোনোভাবেই তারা পাচ্ছেন না। অথচ বড় গলায় বলে বেড়াচ্ছেন, দেশের সব মানুষই তাদের সঙ্গে আছে এবং তারা এই সমর্থন নিয়েই সরকারকে ঠেলে সরিয়ে দেবেন। নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই তাদের। সরকারকে যে ঠেলে নামিয়ে দেবেন, সে বিষয়ে কি কোনো অগ্রগতি আছে? সেটা কি তারা দেখাতে পারছেন? পারছেন না। এদিকে সরকারকে ফেলতেও পারবে না, অপরদিকে নির্বাচনেও যাবে না-তাহলে কি দাঁড়াবে? এটাও কেউ বুঝতে পারছেন না।
বিএনপি কেন, কোনো বিরোধী দলের কথাই কেউ বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। ২০ দল, ১২ দল, ৬ দল বা কোনো ছোট-বড় জোট-কিছুতেই কিছু করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ মহাশক্তি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কেউ-ই পেরে উঠছে না। পারবেই বা কী করে। আওয়ামী লীগ গত ১৪ বছর ধরে সরকারে থেকে যা কিছু করেছে, তা সবই জনগণের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই করেছে। বিগত ১৪ বছর ধরে একের পর এক অর্জনে জনগণ খুবই খুশি। মাঝেমধ্যে বৈশ্বিক কারণে কিছু ঝড়ঝাপ্টা এলেও, তা সুন্দরভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার সরকার। এত কিছু পাওয়ার পর জনগণ কেন অন্যের কথা শুনবে বা অন্য দলের পেছনে ছুটবে? একদিকে যেমন একের পর এক সরকারের সাফল্য জ্বলে উঠছে, অপরদিকে একের পর এক ব্যর্থতায় ম্লান হয়ে যাচ্ছে বিএনপি। নতুন বছর ২০২৩ সালও বিএনপির জন্য চরম ব্যর্থতা নিয়ে আসবে, যদি দলটি তার মনোভাব পরিবর্তন না করে। এই পরিবর্তন হবে নির্বাচনমুখী। বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার মনোভাব। আর এই মনোভাব আনতে গেলে এখন থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু তেমন কোনো ভাবত দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টি এখন এমন যে, নৌকার পালে বাতাস লেগেছে, অপরদিকে ধানের শীষ পোকায় খাচ্ছে। বিষয়টি বুঝতে দেরি করলে ধানের শীষ পোকায় খেয়ে শেষ করে দেবে। অপরদিকে বাতাস পেয়ে নৌকা তরতর করে গন্তব্যে এগিয়ে যাবে। তার পরও তারা বলবে, এই সরকারকে টেনে নামাতে হবে এবং কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। এই একটি মরা দাবি নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। বর্তমানে কিছু ছোট ছোট দল তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। বিএনপির চক্রে তারা কেন বাঁধা পড়ল সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। কি উদ্দেশ্য তাদের, তাও পরিষ্কার নয়। এটা কি আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি বলে অন্য ছোট দলগুলো মনে করছে? যদি তাই হয়, তাহলে ভাালো।
সমস্যা হলো বিএনপিকে নিয়ে। সে কী করবে? বিএনপির কোনো নেতাকে জিজ্ঞেস করলে বলবেন-‘আমরা সরকারকে সরিয়েই নির্বাচন করব। জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। সরকারকে অপসারণ অথবা পদত্যাগে বাধ্য করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’ কিন্তু নিজেরা ভুলে গেছেন যে, সরকারের পদত্যাগ করাতে গিয়ে নিজেরাই সংসদ থেকে পদত্যাগ করে চলে গেছেন। তাদের মধ্যে কেউ আবার উপনির্বাচনে নির্বাচনও করবেন বলে জানা গেছে। তাহলে কি দাঁড়াল। বিএনপি কার কথায় চলে। কে নির্দেশ দেন। এটাও পরিষ্কার, বিএনপির নির্দেশ আসে লন্ডন থেকে। এখানে যারা আছেন, তাদের কোনো কিছুই বলার নেই। বলতে চাইলেও বলতে পারেন না। লন্ডনে বসে যা রেকর্ড করা হয়, বাংলাদেশে তা বাজানো হয়। এই হলো বিএনপির নেতৃত্ব। এই নেতৃত্ব এখন যে পর্যায়ে আছে, ভবিষ্যতে তা আরও ব্যর্থ হবে নাকি কোনো সাফল্য বয়ে আনবে, তা সময় হলেই জনগণ বুঝতে পারবে। বিএনপির রাজনীতির বর্তমান অবস্থা দেখে এ কথাও বলা যায় যে, আসলে বিএনপি কখনোই কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল, তা পারেনি। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হতে যা কিছু দরকার, তার কিছুই নেই বিএনপিতে। এক রাজার খেলা। অন্য কাউকে খেলার কোনো সুযোগ দেয়া হয় না। যখন দলটি গঠিত হয়, তারপর সবাই মিলেমিশে খেলত। তবে তখনও দলটি পরিচালিত হতো বিদেশি নির্দেশনায়। পরে সেই বিদেশি নির্দেশনা রয়ে গেল; কিন্তু মিলেমিশে খেলা হলো না। যার ফলে এখন দলটির এই অবস্থা। এই অবস্থার ক্রমেই অবনতি ঘটবে। উন্নতির কোনো কারণ নেই। যদিও নেতারা অন্য কথা বলছেন। কিন্তু যা বলছেন, তা তো হচ্ছে না। তবুও বলেই যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া আরও একটি যে বড় দল আছে, তা তারা বেমালুম ভুলেই গেছেন। জাতীয় পার্টির কথা বলছি। জাতীয় পার্টি বলে একটা দল আছে। শুধু দলই নয়, পার্লামেন্টে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃত। বিএনপিকে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে গণ্য করা হলেও অফিসিয়ালি বিরোধী দল হলো জাতীয় পার্টি। বিএনপি নির্বাচনে না এলে বা আগ মুহূর্তে নির্বাচনে এলে, সংসদে বিরোধী দলের আসন নিতে পারবে না। এতে আরেক দফা পরাজয় হবে বিএনপির। বিএনপির গন্তব্য গণঅভ্যুত্থানে সরকারের পতন। অপরদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, সে ক্ষমতা বিএনপির নেই। বিগত কর্মকাণ্ডে জনগণ বিএনপি থেকে দূরে সরে গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, নৌকার পালে হাওয়া লেগেছে, অপরদিকে ধানের শীষে পোকা ধরেছে। বিএনপির অবস্থা হবে এমন যে, তারা সরকারকে সরাতেও পারবে না, নির্বাচনেও যাবে না। শেষ পর্যন্ত এটাই যদি হয়, তাহলে আবার ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ এবং সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। বিএনপি বাইরে থেকে বিদেশি প্রভুদের নির্দেশই পালন করে যাবে। তাই এখনও সময় আছে, দলটিকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে উদ্যোগ নিতে হবে। আর তা করতে হলে নির্বাচনমুখী হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।