সিন্ডিকেট বাণিজ্যের বিধ্বংসী থাবায় আক্রান্ত সর্বদা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ; চিরকাল যারা দেশকে দিয়ে গেছে বেশি, নিয়েছে কম। দেশের অর্থনীতির শিরা-উপশিরায় যাদের ঘাম জড়ানো বিশুদ্ধ রক্ত টনিকের মতো প্রবাহমান। কিন্তু শোষিত এ শ্রেণির না আছে অভিযোগের স্থান, না আছে প্রতিবাদের ভাষা, না আছে সমস্যার সমাধান।
সদ্যবিধ্বস্ত দেশের পোলট্রি খামারিদের অবস্থা লক্ষ্য করলে সহজেই বোঝা যায় সিন্ডিকেট হায়েনার থাবা কতটা ভয়ংকর। কোন প্যাথলোজিক্যাল টেস্ট কিংবা মেডিসিন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই, খামারিদের অসহায় চোখণ্ডমুখই বলে দেয়, তারা নিস্তেজ, সর্বশান্ত, তারা আর পারছে না। যে কারণে ক্রমান্বয়ে দেশের ১ লাখ ৯০ হাজার পোলট্রি খামার কমে, এখন ১ লাখের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে; আর ৯০ টাকা ডজনের ডিম, মানুষ ১৬০ টাকায় ক্রয় করতে বাধ্য হয়েছে। বাজারে শীতের সবজি সরবরাহে যদিও ডিম ও মুরগির দাম কমতে শুরু করেছে, তা ভোক্তা সাধারণের জন্য সুখবর হলেও, খামারিদের জন্য দুঃসংবাদ। কারণ, ফিড সিন্ডিকেট সম্প্রতি ফিডের মূল্য ১০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। মূলত পোলট্রি পণ্যের মূল্যে, হ্রাস-বৃদ্ধি কোনটার সুফলই খামারিদের ভাগ্যে জোটে না।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পরিবারের বেকারত্ব অবসানের লক্ষ্যে স্বপ্রণোদিত কর্মসংস্থান গড়তে গিয়ে, সর্বস্ব হারিয়ে এখন পথে বসার অবস্থা। পোলট্রি সেক্টর ঘিরে সিন্ডিকেটের সংখ্যা কম করে হলেও সাতটি। ১. পুলেট সিন্ডিকেট ২. ফিড সিন্ডিকেট ৩. ডিম সিন্ডিকেট ৪. ওষুধ সিন্ডিকেট ৫. ভুয়া ওষুধ সিন্ডিকেট ৬. চিকিৎসক সিন্ডিকেট ৭. হাতুরে চিকিৎসক সিন্ডিকেট। এই সাতটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগী বিশাল এক দালাল সিন্ডিকেট জড়িত, যে চক্রটি লেখা পড়া না জানা অধিকাংশ সাধারণ খামারিদের রক্তচুষে নিজেরাও খাচ্ছে, উপরের সাত সেন্ডিকেট চক্রকেও খাওয়াচ্ছে। এছাড়া খামারিদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে বছরব্যাপী প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ধারাবাহিক বরাদ্দ সিন্ডিকেট তো আছেই। অধিকাংশ বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফিড উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাদের অভ্যন্তরীণ কারসাজির ভুক্তভোগী কখনও খামারি কখনও ভোক্তা সাধারণ। পোলট্রি ফিড উৎপাদনের প্রধান উপাদান ষাটভাগ ভুট্টা, যার বর্তমান বাজার দর, ৩৬ টাকা হতে ৩৮ টাকার বেশি নয়। অথচ, লেয়ার ও ব্রয়লার ফিড যথাক্রমে, ৫৯ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে খামারিরা। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ১৮০০ টাকার পোলট্রি ফিডের দাম বেড়ে এই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। দ্রুততম সময়ে এই সিন্ডিকেট ভাঙার ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই মুখ থুবরে পরবে পোলট্রি খাত। যার পরিণতিতে অর্থনীতি উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য; এরই মধ্যে যা শুরু হয়ে গেছে। কারণ, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ খাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ লোকের জীবিকা।
সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে ১৩৭ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। খামার প্রতিষ্ঠার আগের শর্ত যেখানে নিরাপদ পানি ও জীবাণু মুক্ত পরিবেশ, সরকারি উদ্দ্যেগে, বাধ্যতামূলক শর্ত হওয়া উচিত, সেখানে খামারিদের প্রশিক্ষিত করতে চোখে পড়ার মতো কোনো কর্মসূচি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাধ্যতামূলক কর্মসূচিতে নেই; অথচ এটি অপরিহার্য। তাহলে, যেখানে ন্যূনতম প্রাথমিক পাঠ বাস্তবায়নের ব্যবস্থাই নেই, সেখানে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দের কি উদ্দেশ্য, তা বোধগম্য নয়।
অথচ যে কয়েকটি রোগের উপর ভিত্তি করে ওষুধ বাণিজ্য চলছে এবং খামারিরা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তার ৮০ শতাংশ নিরাময়যোগ্য, শুধু পানি ও পরিবেশের উপর সচেতনামূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে। প্রতি জেলায় জেলায় প্রশিক্ষিত টিম গঠন করে ভ্রাম্যমাণ কর্মসূচির মাধ্যমে তৃণমূল খামারিদের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে। কারণ, তৃণমূল পর্যায়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পরিবারের সবাই মিলে খামার পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু, অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কেউ গায়েই মাখছে না। পোলট্রি সেক্টরের এটিই বাস্তব চিত্র। রোগ ও ঝুঁকিমুক্ত খামার বাস্তবায়নে বাস্তবভিত্তিক কোনো পদক্ষেপ প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই, যা বাস্তবায়ন করলে বাঁচবে খামারি আর খামারভিত্তিক অর্থনীতি।
ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশের পোলট্রি সেক্টর সরকার কিম্বা বড় কোনো শিল্প উদ্যোক্তার আশীর্বাদের ফসল নয়। প্রায় তিন যুগ আগে নিতান্ত পারিবারিক বেকারত্ব ঘুচাতে প্রান্তিক পর্যায়ের মহিলাদের হাতে ১০-২০টি মুরগির বাচ্চা প্রতিপালনের মাধ্যমেই এ সেক্টরের ভিত্তি সূচিত হয়, যা আজ জিডিপির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমাদের উচিত এ সেক্টর রক্ষায় সর্বাত্মক মনোযোগী হওয়া যা এখন সময়ের দাবি। প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতাগুলো ও বিভিন্ন মিডিয়া পার্শ্ববর্তী দেশের নায়ক-নায়িকাদের নগ্ন ছবি প্রকাশে যে পরিমাণ মেধা, লেখালেখি ও কালি-কাগজ খরচ করছে, দেশের পোলট্রি খাত রক্ষায় তার এক হাজার ভাগের একভাগও যদি তুলে ধরত, সরকার বাধ্য হত এ সেক্টর রক্ষায় সমস্যা খুঁজে বের করে সংস্কারে হাত দিতে। দুর্বলভিত্তির উপর বহুতল ভবন নির্মাণ যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, পোলট্রি সেক্টরের ন্যূনতম নীতিমালা ঠিক না করে এখাতে জনগণের করের টাকা ব্যয় করা তেমনি হতবুদ্ধিতা।
একটা সময় ছিল দেশের ৭০ ভাগ মানুষ বছরে ১০ থেকে ১৫টি ডিম ও ৫টি মুরগি খাওয়ার কথা ভাবতেও পারত না। গরুর মাংস খাওয়াত বিশেষ কোনো পার্বন ছাড়া চিন্তাও করত না। আজ তারাই এসব পণ্যের উৎপাদক হওয়ায় নিম্নমধ্যবিত্ত হতে শুরু করে বিত্তশালী, সবার জন্য ডিম ও প্রাণিজ আমিষ প্রাপ্তির সহজলভ্য ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে পোলট্রি খাত। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবার কাছে পণ্য দুটির চাহিদাও শীর্ষে। কাজেই সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর দায়িত্ব, বিশৃঙ্খল এ সেক্টরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে খামারভিত্তিক অর্থনীতিকে সচল করা। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের সরকারের কাছে এ মুহূর্তে এমনটিই প্রত্যাশা।