মতামত
বিএনপির রাজনৈতিক দৈন্যতা : কাঠামোগত বিশ্লেষণ
ড. এ. এইচ. এম মাহবুবুর রহমান, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শুরুতেই দলটির যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের সংবিধান, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে। ইসলামি দর্শনে বিশ্বাস, সামাজিক ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে দলের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে চারটি মূলনীতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়, তার প্রতিফলন বিএনপির মূলনীতিতে নেই। পাকিস্তানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের আদলে সরাসরি অনুসরণ না করে ইসলামি দর্শনে বিশ্বাসকে দলের নীতি হিসেবে ঘোষণা করে। সামাজিক ন্যায়বিচার বলতে কউ বোঝানো হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্যকে হয়তো মুখে স্বীকার করতে চায়নি, তাই সামাজিক ন্যায়বিচার পরোক্ষভাবে বুঝিয়েছে। গণতন্ত্র রেখেছে, রাজনৈতিক দল হিসেবে রাখতে হয় সে কারণে। জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশি ঘোষণা করে ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে অস্বীকার করে ১৯৭৮ সাল থেকে বাঙালির ইতিহাস শুরু করেছে। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ফেলে দিয়ে বাংলাদেশি করা হয়।
বাংলাদেশের সবক’টি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে, রাজপথে জনগণের দাবি আদায়কে কেন্দ্র করে। রাজপথ থেকে, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে। বিএনপি জন্ম হয়েছে ক্ষমতার মসনদে বসে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করে। ২৪ আগস্ট সেনাবাহিনী প্রধান শফিউল্লাহকে অপসারণ করে খোন্দকার মোশতাক জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করে। ৩ নভেম্বর খোন্দকার মোশতাকের নির্দেশে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। ৪ নভেম্বর খালেদ মোশারফ জিয়াকে গৃহবন্দি করে নিজে সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব নেন। ৫ নভেম্বর খোন্দকার মোশতাককে অপসারণ করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়। খালেদ মোশারফ, খোন্দকার মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠান। ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহের ও জাসদের গণবাহিনীর নেতৃত্বে জিয়াকে মুক্ত করে খালেদ মোশারফকে হত্যা করা হয়। জিয়া মুক্ত হয়ে নিজেকে সামারিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দেন। অভিযোগ আছে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়ার নেপথ্য হাত রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে জিয়া ছিলেন সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন জেনারেল শফিউল্লাহ। সেনা কর্মকর্তা হলেও জিয়া ছিলেন উচ্চাভিলাষী। বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি থাকলেও, উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াই মূলত রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। সায়েম সাহেব ছিলেন পুতুল মাত্র। সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ২ উপধারায় যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, জিয়াউর রহমান এই নিষেধাজ্ঞা তুলে যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দেন। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল বিধি প্রণয়ন করে বলেন ‘আই উইল মেক পলিটিক্স কমপ্লেক্স’। দল বিধির নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দেয়। আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে ‘বঙ্গবন্ধু’ উল্লেখ থাকায় দল নিবন্ধন অনুমোদন বাতিল করে দেয়। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিলে অনুমোদন দেয়া হয়।
১৯৭৭ সালে দেশে নির্বাচন হবে বলে প্রেসিডেন্ট সায়েম ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণা বাতিল করতে মওলানা ভাসানীকে দিয়ে জিয়াউর রহমান বিবৃতি দেওয়ান যে ‘দেশে এখন নির্বাচনের পরিবেশ নেই, আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের কবল থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে।’ প্রতিদান হিসেবে ভাসানীকে লন্ডনে পাঠান চিকিৎসার জন্য। নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতে জিয়া ১৯৭৬ সালের ২৮ নভেম্বর গভীর রাতে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট সায়েমের কাছ থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে একচ্ছ্রত্র ক্ষমতার অধিকারী হন। ক্ষমতা লাভের ধারাবাহিকতায় ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট সায়েমকে স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হন। উচ্চাভিলাষী মেজর জিয়া একাধারে সেনাবাহিনী প্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। ২২ মে সংবিধানের দার্শনিক ভিত্তি পরিবর্তন করে দেয়া হয়। বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক সংবিধান ‘প্রস্তাবনা’ দিয়ে শুরু হয়েছিল জিয়া প্রস্তাবনার ওপরে যোগ করলেন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। নাগরিকদের পরিচয় সংবিধানে ছিল ‘বাঙালি’, জিয়া সেটা কেটে বানালেন ‘বাংলাদেশি’। অর্থাৎ সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধকে ভূলুণ্ঠিত করে পাকিস্তানের ধ্যান-ধারণায় এবং আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সংবিধানকে কেটে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার ঘোষণা থাকলেও জিয়া তা বাতিল করে দিলেন। ১৯৭৭ সালের ২২ মে জিয়া দেশ গঠনে ‘১৯ দফা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার বৈধতার স্বীকৃতি আদায় করতে হ্যাঁ-না ভোটের মাধ্যমে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে গণভোটের আয়োজন করে অবিশ্বাস্যভাবে ৯৮.৯ শতাংশ ভোটারের সমর্থন আদায় করে নিজের আসন পাকাপোক্ত করে নেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর খুনিদের খুশি করতে বিদেশে অবস্থিত দেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরির ব্যবস্থা করেন। ৩০ জুন বিচারপতি সাত্তারকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে রাজনীতির পাঠ্য নিতে শুরু করেন।
ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে জিয়া একটি রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য কাজ করতে থাকেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নেতাদের বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে নিজের দলে আনার জন্য ক্যান্টনম্যান্ট থেকে প্রভাব খাটাতে শুরু করেন। ন্যাপ (ভাসানী) সভাপতি মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে দল গঠনে সদস্য হতে প্রথম আহ্বান করেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী কাতারের রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের শাহ আজিজুর রহমান, ইউপিপির কাজী জাফর আহমেদসহ বিভিন্ন ছোট ছোট দল নিয়ে ১ মে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। এরপর বিচারপতি সাত্তারকে আহ্বায়ক করে ১৯ সদস্যের জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) গঠন করে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগ দেন।
৩ জুন ১৯৭৮ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দিয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট নেতা জিয়াউর রহমান ৭৬ শতাংশ ভোট ছিনিয়ে নিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এম এ জি ওসমানী ২১ শতাংশ ভোট পেয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। মূলত এই নির্বাচন ছিল জিয়ার রাষ্ট্রপতি হওয়ার একটি আয়োজন মাত্র। জেনারেল ওসমানী সাংবাদিক সম্মেলন করে ১৩টি অভিযোগ করেছিলেন প্রথম অভিযোগ ছিল ‘নির্বাচনের একদিন আগেই পোলিং অফিসারদের সিল ও সই দেয়ার জন্য ব্যালট পেপার দেয়া হয়েছিল ফলে জাল ভোট দেয়া সহজ হয়েছিল।’ জিয়ার মন্ত্রিপরিষদে স্থান পান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী শাহ আজিজুর রহমান, আব্দুল আলীম, মশিউর রহমানসহ সব পাকিস্তানপন্থি দলের নেতারা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ জিয়াউর রহমান নিজে চেয়ারম্যান ও বদরুদ্দৌজা চৌধুরীকে মহাসচিব করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিএনপি একটি অগণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিদের নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল। ফলে সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনায় পরিপুষ্ট ও রাজনৈতিক দৈন্যতায় ভোগছে দলটি। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে এ দলটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে এদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হত্যা, গুম, বাড়িঘর জ্বালাও পোড়াও করে এক বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি করেছে। রাজাকার আল বদরদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছে। ধর্মীয় উগ্রতা, জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীকে অত্যাচার করে এক মধ্যযুগীয় অবস্থা সৃষ্টি করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানি আদর্শে পরিচালিত করতে তৎপর। বিএনপির এই রাজনৈতিক দৈন্যতা দূর না হলে, এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ তাদের কখনই গ্রহণ করবে না।