শীতকালীন ছুটি চলছে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি)। ফাঁকা ক্যাম্পাসে, সুনসান নীরবতা। হঠাৎ দুপুরে শাহেদ ভাইয়ের ফোন, চল যাই কুষ্টিয়া ঘুরে আসি। কোন কিছুই না ভেবে ৩টার বাসে রওনা হলাম। বিশ্বিবদ্যালয় থেকে কুষ্টিয়া শহর ২৪ কি.মি. দূরে অবস্থিত, নিয়মিত ক্যাম্পাস থেকে শহরে বাস আসা যাওয়া করে। গল্পে গল্পে হঠাৎ শহরে এসে পড়লাম। নেমেই হাটা শুরু করেছি হাতে অফুরন্ত সময়। শহরের এক দিক থেকে অন্য দিকে হেঁটেই চলছি। ভাবলাম গড়াই ব্রিজের নিচে ঘুরে আসি। নদীর ধারেও একদিক থেকে অন্যদিকে হাঁটাহাঁটি। একে অপরের মাঝে চলছিল জীবনের গল্প। পাশেই বস্তি, একটু আগালেই বিশাল বড় বড় স্থাপনা। এটিও মানবজীবনের প্রকৃতির অংশ। জীবন চলার পথের বিচিত্র একেক স্থানে একেক রকম। কেউ দিনে একবার খেয়ে পড়ে বাঁচে, কারও আবারও তাও মেলে না। আবার এমন হাজারও লোক রয়েছে, যারা হাজার মানুষের খাবার নষ্ট করে থাকি। যদিও বা রুপকথার মতো একটি কথা রয়েছে মানুষে মানুষে নেই ভেদাভেদ। ভাবতে গেলে সেই অংশটিও ভেদাভেদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। বাস্তবতা এমনই। আমাদের কথাগুলো চলতেই পাশেই ২৫ বছর বয়সি এক যুবক হেঁটে যাচ্ছে। তার একটি হাত অকেজো সে দিব্যি নিজেকে মেনে নিয়েই চলছে। নিজের হাত একটু দেখে নিলাম ঠিক আছে কি-না!
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এল। আমরা এখনও হাঁটার পথেই আছি ভাই- বলল, চলো চা খেতে যাই। কুষ্টিয়া শহরের রেলওয়ে স্টেশনের পাশে অসাধারণ টেস্টের চা পাওয়া যায়। আবারও চলছি হেঁটে নদীর ধার থেকে সরাসরি স্টেশন। পথে মাঝ বয়সি এক মহিলাকে দেখছি ছোট বাচ্চাদের জন্য বেলুন বিক্রি করছে। সঙ্গে আছে তার ৭ কিংবা ৮ বছর বয়সের মেয়ে। মা-মেয়ের গল্প চলছে, সংসারের জন্যও যুদ্ধ করছে। দেখে ভালো লাগল, আবার একটু খারাপও লাগল। এ ছোট্ট মেয়েটির এখন পড়ালেখার সময়, পড়ার সময়ে সে তার মায়ের সঙ্গে রাস্তায় বসে জীবিকার সন্ধানে রয়েছে। কেন যেন মনে হয় মানুষের মাঝে বিভেদ রয়েছে, মানুষের মাঝে উঁচু-নিচুর পার্থক্য আছে, এটি থাকবেই। সত্যি মানুষের জীবনের ধাপগুলো একেক স্থানে একেক রকম।
ভাবতে ভাবতে চলে এলাম স্টেশনে। অনেক বৃদ্ধা দেখি প্ল্যাটফর্মের বুকজুড়ে শান্তির ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কনকনে ঠান্ডা চারিদিকে খোলা হাওয়া শীত বস্ত্র মুড়ে ঠান্ডাকে প্রতিরোধের চেষ্টা। এসব দেখতে দেখতে হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল এক বৃদ্ধার দিকে, বয়স ৭০-এর কাছাকাছি বা অধিকও হতে পারে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ্য হয়ে পড়েছে। তার অবস্থা দেখে মনে হয় শরীরের ভার হয়তো আর সহ্য হচ্ছে না। চলার শক্তি ক্ষীণ হয়ে গেছে, দেখার মতো হয়তো কেউ নেই। যে বয়সে তার পারিবারিক সেবার মাধ্যমে দিনগুলো কাটানোর কথা, সে বয়সে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের পাহারাদারের জীবন বেছে নিতে হয়েছে। যেখানে এই বৃদ্ধা বয়সে সেবা পাবার পরও যে কষ্ট করতে হয়, অথচ এই অজানা বৃদ্ধাসহ হাজারও বৃদ্ধ সেবা শুশ্রƒষা ছাড়াই যন্ত্রণার এই জীবনকে বরণ করে নিয়েছে। মৃত্যুর পথযাত্রী অসুস্থ সেবাহীন বৃদ্ধাগুলো হয়তো কবি মির্জা গালিবের কথাটুকু নিজের ভাষায় প্রকাশের চেষ্টা করে। ‘কই, মৃত্যু তো আসে না গালিব, ‘বেঁচে থাকার জন্য কতদিন আফসোস করব?’। এ কষ্টের তীব্রতা লেখায় প্রকাশের যোগ্যতা নেই। জীবন যুদ্ধের নিয়তির খেলায় হিসেবের মাত্রা কমিয়ে তারা হয়তো জিতে গেছে।
এমনই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মসহ দেশের পথের ধারে হাজার হাজার পথ শিশু, বৃদ্ধা মা-বাবা, বাক-প্রতিবন্ধী নাম পরিচয়হীন নিঃস্ব অসহায় মানুষ রয়েছে, যারা ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে। পত্রিকা পাতায় দুই একজনের খবর উঠে এলেও অজানা পৃথীবিতে রয়ে যায়, হাজার হাজার এ পথের যাত্রী। যন্ত্রণানামক সুখের বিপরীত ভাষার দীর্ঘপথের সমাপ্তি ঘটবে কী কখনও এ মানুষগুলোর জীবনে?
* শিক্ষার্থী
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়