একটা সময় দেশে প্রথাগত ব্যবস্থায় সন্তান জন্ম দেয়া হতো। ‘দাই’ নামের একটি শ্রেণি ঘরে ঘরে গিয়ে এই কাজটি করত। এখন প্রচলিত এই ব্যবস্থাটি অনেকাংশে বিলুপ্ত হয়েছে। এ ব্যবস্থাটি অনেকটা পারিবারিক পেশার মতোই ছিল, একইসঙ্গে ঝুঁকিমুক্ত ছিল না। কারণ দাইরা অভিজ্ঞতা থেকে এই কর্মকাণ্ডটি পরিচালনা করত, অর্থাৎ এখানে শিক্ষাগত প্রশিক্ষণের বিষয়ের বালাই ছিল না। পবর্তী সময়ে সচেতনতার ধারাবাহিকতায় আধুনিক ব্যবস্থা প্রচলিত হয়, হাসপাতাল-ক্লিনিকে শিশু জন্মদানের উন্নতর পদ্ধতি প্রচলিত হয়। এরই পরিক্রমায় সিজার নামে এ পদ্ধতি বেশ প্রচলিত হয়ে উঠেছে, যেখানে পেট কেটে অভিজ্ঞ ডাক্তাররা ব্যথামুক্তভাবে নিরাপদে শিশু জন্মদানে সহায়তা করে থাকেন। মূলত বিশেষ ক্ষেত্রে ঝুঁকিমুক্ত শিশু জন্মদানে সিজার পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলেও এখন এটি সাধারণ ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে, যা শিশু ও মায়ের জন্য ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণ হয়, যা কিছুতেই প্রত্যাশিত নয়। অথচ ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য হলেও এই পদ্ধতিটি বেড়েই চলেছে, অনেক ক্ষেত্রে এটা ফ্যাশনেও পরিণত হয়েছে। আর একশ্রেণির বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক রয়েছে, এরা ব্যবসায়িক কারণে সিজার করাতে উৎসাহিত করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রসঙ্গত, চিকিৎসার জন্য গর্ভবতী নারীরা বেসরকারি কোনো হাসপাতালে গেলেই তাদের সিজার করে দেয়া হয় বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে সিজার হলেই অতিরিক্ত সুবিধা।
সদ্য এক জরিপে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের ১১টি সিটি করপোরেশনে বস্তিতে বসবাসকারী গর্ভবতী নারীর ৩১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেন। সেসব সিটি এলাকায় বস্তির বাইরে থাকা ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ নারীর সন্তান জন্মদানও হয় সিজারে। আর দেশের জেলা-উপজেলাগুলোতে যেসব শহরে ৪৫ হাজারের বেশি মানুষের বাস সেসব শহরের ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ নারী সিজারে সন্তান জন্ম দেন। তবে গর্ভাবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক সেবা নেয়া নারীদের সিজারে সন্তান জন্মদানের হার বেশি। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) এক জরিপ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপ থেকে প্রতীয়মান, গরিব, মধ্যবিত্ত ও ধনী সব শ্রেণির মানুষই সিজারে আগ্রহী হয়ে ওঠেছেন। অথচ এটা স্বতঃসদ্ধি যে, সিজারে ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। এতে স্বাভাবিক জন্মদানের ক্ষমতা কমে যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন মেয়েরা অনেক সময় অধৈর্য হয়ে যান, তারা স্বাভাবিক জন্মদানের প্রস্তুতি নিতে চান না। এদের ‘অন ডিমান্ড’ দাবিতেও অনেক সময় ডাক্তারকে বাধ্য হয়ে সিজারে যেতে হয়। অথচ এতে ইনফেকশন হতে পারে, রক্তপাতও হতে পারে। তাছাড়া বাচ্চার জটিলতা বেড়ে যেতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা বা নিউমোনিয়া হতে পারে। অজ্ঞান করার জটিলতাও বেড়ে যেতে পারে। সোজাকথায়, একটা ‘রিস্ক’ নিয়েই সিজার করতে হয়।
সন্তান জন্মদানে কোনো ধরনের ঝুঁকিতে না যাওয়াই শ্রেয়। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে স্বাভাবিক জন্মদানই ভালো প্রক্রিয়া। আশা করা যায়, এদিকে সব মা ও পরিবারের দৃষ্টি নিবদ্ধ জরুরি। এজন্য গর্ভধারণের পর অবশ্য মায়ের স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। জন্মদান পর্যন্ত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। জোরপূর্বক সিজার কিছুতেই প্রত্যাশিত নয়। এই নিয়ে ডাক্তার ও ক্লিনিক-হাসপাতালগুলোকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। যতটা সম্ভব সিজার পরিহার করতে হবে।