ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কালের কড়চা

বাংলাদেশকেন্দ্রিক কূটনৈতিক যুদ্ধ ও মস্কো-বেইজিং সম্পর্ক

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, [email protected]
বাংলাদেশকেন্দ্রিক কূটনৈতিক যুদ্ধ ও মস্কো-বেইজিং সম্পর্ক

বাংলাদেশ নিয়ে বৈদেশিক কূটনৈতিকদের নানা রকম কথা বলা ও মন্তব্য করার ঘটনা নতুন কিছু নয়। আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অভ্যন্তরীণ পারস্পরিক সৃষ্টকৃত দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির সুযোগে বিদেশিদের কথা বলার সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। এ জন্য যতটা না তারা দায়ী তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী আমাদের দুর্বল চিন্তার রাজনীতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে একটি আত্মমর‌্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করেছিলেন। বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশকে পূতঃপবিত্র ভূখণ্ডের মর‌্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট একটি ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে জাতীয় ঐক্যের সুস্পষ্ট নীতি প্রতিষ্ঠার কাজে সবে মাত্র হাত দিয়েছিলেন। এর মধ্যেই এমন বর্বোরোচিত ঘটনা ঘটে যায়। যে জন্য আর জাতীয় ঐক্যের নীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। জাতি হয়ে যায় দ্বিধাবিভক্ত। বদলে যায় রাজনীতির প্রকৃতি। রাজনীতি হয়ে উঠে বাণিজ্য সর্বস্ব। বাণিজ্য সর্বস্ব রাজনীতির উদ্ভাবক জেনারেল জিয়া সেটা বোধ হয় কারও অজানা নয়। বাণিজ্য সর্বস্ব রাজনীতিতে সংঘাত অনিবার্য এ কথা আজ প্রমাণিত সত্য। এ পরিস্থিতিতে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের রাজনীতিতে বিদেশিরা সুযোগ গ্রহণ করবেই এতে আর বিচিত্র কী! এর মধ্যে আবার ধর্মীয় উন্মাদনার উপসর্গও যুক্ত হয়েছে রাজনীতিতে ফলে হযবরল রাজনীতির মাঠে বৈদেশিক আস্ফালন আমাদের সহ্য করতেই হচ্ছে। পাঠক বৃন্দের ভুলে যাবার কথা নয় যে, স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর গণতন্ত্রের কিছুটা আবহাওয়া বইছিল। কিন্তু সে হাওয়া আবার রাজনীতির বিষবাষ্পে রূপান্তরিত হয়। সেই বিষ নিগর্মনে আমাদের রাজনীতিকরা সজ্ঞানে সুস্থ মস্তিষ্কে বিদেশিদের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার গভর্নর স্যার নিনিয়ান স্টিফেন এসেছিলেন ১৯৯৪ সালে। শক্তিধর রাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এসেছিলেন ২০০১ সালে। জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারিও এসেছিলেন। এসেছিলেন আরও অনেকে, এরা সবাই আমাদের রাজনৈতিক বিবাদ মিটানোর উদ্দেশ্যেই এসেছিলেন, তাদের আগমন আমাদের রাজনীতিকদের উদার আমন্ত্রণকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূতরাও আমাদের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিয়মিত কথা বলে আসছেন। মানবাধিকার, আইনশৃঙ্খলা ও গণতন্ত্রের বিষয়ে রাষ্ট্রদূতদের বিরামহীন কথা বলা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমাদের রাজনীতিকরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নালিশ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। ফলে ভিয়েনা কনভেনশনের রুল অব বিজনেসের ধার ধারার প্রয়োজন বোধ করে না বিদেশি কূটনীতিকরা।

যাহোক সম্প্রতিকালে একটি নতুন চমক দেখা গেল। সেটি হচ্ছে বিদেশি কূটনীতিকদের বাংলাদেশকেন্দ্রিক বাগ্যুদ্ধ। ঘটনাটি ১৪ ডিসেম্বর ২০২২-এর। এই দিন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গিয়েছিলেন ১৩ বছর আগে নিখোঁজ হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলামের শাহিনবাগের বাসায়। সেখান থেকে ফেরার সময় একদল লোক তাকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করলে নিরাপত্তা বাহিনীদের সহায়তায় দূতাবাসে ফেরতে সক্ষম হন। এ ঘটনায় তিনি নিজেকে নিরাপত্তাহীন মনে করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন জরুরিভিত্তিতে। বিষয়টি রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা ইস্যুতে আলোচনার ঝড় ওঠে। এতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর‌্যায়ে উদ্বেগ জানায়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানের সঙ্গে পিটার হাসের নিরাপত্তা বিষয়ে কথা বলেন। এদিকে ২০ ডিসেম্বর ২০২২ ঢাকার রুশদূতাবাস একটি বিবৃতি দিয়ে জানায়, বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে রাশিয়া সর্বদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর পরদিন ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এক টুইট বার্তায় প্রশ্ন রাখে, রাশিয়ার এ নীতি কি ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? সঙ্গে সঙ্গে ওই দিন সন্ধ্যায় রুশ দূতাবাস টুইটে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার সমালোচনা করে একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে। শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া কূটনীতিকের বাগযুদ্ধ। বাংলাদেশ কেন্দ্রীক এই বাগযুদ্ধ রাজনীতিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করে। তাদের এ বাগ্যুদ্ধ শুধু রাষ্ট্রদূতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। গোটা পশ্চিমা দেশগুলোতে এর প্রভাব পড়ছে। উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি প্রকাশ্যে পরামর্শ দিয়ে আসছে। এসব পরামর্শকে আভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপের শামিল মনে করে রাশিয়া। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এক বিবৃতিতে একথা জানিয়েছেন। বিবৃতিতে মারিয়া জাখারোভা আরও উল্লেখ করেন যে, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশের নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষার কথা বলে ক্রমাগত বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। রুশ মুখপাত্র জার্মান রাষ্ট্রদূত প্রসঙ্গেও একই কথা বলেছেন। এসব কর্মকাণ্ডকে ভিয়েনা কনভেশনের চুক্তির লংঘন মনে করেন।’ রুশ মুখপাত্রের কথায় বাংলাদেশ সরকার হয়তো কিছুটা আত্মপ্রসাদ লাভ করছে। কথাগুলো সরকারের পক্ষে হলেও মাজেজাটা অন্য জায়গায়।

রুশ মুখপাত্র এমন এক সময় এসব কথা বলছেন, যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যুদ্ধের রসদ জুগিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের প্রভাবে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের বহু দেশের মানুষ মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কবলে পড়েছে। ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে চলছে। মানবসভ্যতায় হাহাকার তৈরি হয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার বরাবরই যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। যুদ্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না। যুদ্ধে বেসামরিক সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। যা কখনও কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশকেন্দ্রিক কূটনৈতিক যুদ্ধ অতীতে কখনও দেখা যায়নি। হ্যাঁ এটা ঠিক আমরা আমাদের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অন্যকারও নাক গলানো বরদাস্ত করব না। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের সঙ্গে সুন্দর ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রেখে চলার নীতিতে বাংলাদেশ অবিচল থাকবে।

বেইজিং মস্কো সম্পর্ক

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে মস্কোর সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা ঘোষণা করেছে চীন। দেশটির সরকার বলেছে চীন-রাশিয়া সম্পর্ক শক্ত পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আন্তর্জাতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে এ সম্পর্ক অটুট থাকবে।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং-ই ২৫ ডিসেম্বর রোববার একটি সিম্পোজিয়ামে বক্তৃতাকালে একথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ‘মস্কোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ এবং উস্কানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো সংবেদনশীল নয়। কেউ এ সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারবে না। চীন এবং রাশিয়া দৃঢ়ভাবে আধিপাত্যবাদের বিরুদ্ধে এবং ঠান্ডা যুদ্ধের বিপক্ষে কথা বলে।’ তিনি বলেন, উভয় দেশ সক্রিয়ভাবে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নীতি প্রচার করছে, পারস্পরিক কৌশলগত স্বার্থ মোকাবিলা করছে এবং পারস্পরিক আস্থার ওপর নির্ভর করছে।’ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তা চীন সমর্থন করে। তৃতীয় পক্ষের উস্কানি বলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই বুঝিয়েছে। চীন-রাশিয়া এ বন্ধুত্ব স্থাপনে সুদূর প্রসারি পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশকে ঘিরে। বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন সহযোগী দেশ চীন। অন্যদিকে রাশিয়াও উন্নয়নের অংশীদার। রাশিয়া যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুক্ত ছিল, তখন বৃহত্তর পরাশক্তির দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। সেটা এখন অতীত। বিশ্ব রাজনীতিতে সমীকরণ বদলে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর রাজনীতির গতি প্রকৃতিও বদলে গেছে। অর্থনীতিতে চীনের বিস্ময়কর উত্থান গোটা পৃথিবীকে অবাক করেছে। চীনের উৎপাদিত বিভিন্ন ইলেকট্রিক সরঞ্জাম সারা পৃথিবী দখল করে নিয়েছে। এ ছাড়াও পোশাক শিল্পের আগ্রাসন লক্ষ্য করার মতো। ওষুধ শিল্পের একচিটিয়া বাজার দখলের অশুভ চিন্তা থেকে চীন ২০১৯ সালে নিজেদের ল্যাব থেকে মানব বিধ্বংসী করোনাভাইরাস সৃষ্টিতে পৃথিবীকে তছনছ করে দিয়েছে। করোনাভাইরাসে প্রায় কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। অনেক দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। কেউ কেউ এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এই ভাইরাস সৃষ্টি এবং এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করে মানব জাতির বাহবা কুড়াবে। এমন চিন্তা থেকেই চীন এমনটি করেছে। কিন্তু তারা ধরা পড়ে গেছে। যে ভাইরাস দিয়ে পৃথিবী আক্রমণ করে নিজেরা বাণিজ্যের প্রসার ঘটাবে মাস্ক এবং প্রতিষেধক দিয়ে, এখন সেই ভাইরাস তাদেরই ছাড়ছে না। প্রথমে উহান প্রদেশে এর বিস্তার ঘটে। উহানকে অবরুদ্ধ করে নিজের দেশে করোনার বিস্তার ঠেকাতে চেষ্টার ভেতর দিয়ে কৌশলে পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, তাদের ভ্যাকসিনের চেয়ে রাশিয়ার ভ্যাকসিন, ভারতের ভ্যাকসিন, যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যাকসিন অনেক বেশি কার্যকর। জানা গেছে সম্প্রতি চীনে আবার করোনার সংক্রমণ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। লকডাউন কর্মসূচিতে গিয়ে জনগণের বাধার মুখে পড়ছে। লকডাউনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সাধারণ মানুষের ওপর চড়াও হয়েছে সরকার। এমনি পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব সৃষ্টিতে মনোযোগী হয়েছে। এ মুহূর্তে চীনের রাশিয়াকে খুবই প্রয়োজন। রাশিয়ারও দরকার চীনের। চীন পাশে থাকলে যুদ্ধ অব্যাহত রেখে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে পারবে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের ভূমিকার কথা। দীর্ঘদিন ধরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সে দেশে ফেরত পাঠাতে পারছি না। কৌশলগত সুবিধা চিন্তায় চীন-রাশিয়া সম্পর্ক যে পর‌্যায়ে রয়েছে তা অব্যাহত রাখতে দরকার হবে মানব-সম্ভাবনা বিজ্ঞান নামে একটি নতুন বিজ্ঞানের। এ বিজ্ঞানের বিকাশ সমগ্র পৃথিবীতেই দরকার। তা না হলে সবই কথার কথা হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত