ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাতীয় স্বার্থে বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ প্রয়োজন

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স্বর্ণ পদক) প্রাপ্ত
জাতীয় স্বার্থে বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ প্রয়োজন

যারা প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করেন তারা ভালো করেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, লাতিন আমেরিকা আর আফ্রিকার কোনো কোনো পাহাড়ি অঞ্চলে বৃক্ষগুলো সব ঋতুতেই থাকে সতেজ। চিরহরিৎ অরণ্যের বৃক্ষগুলোর পাতা ঝরে পড়ে না, বিবর্ণ হয় না, দান-বাকৃতির বিশাল এসব গাছ ঠান্ডায় কাবু হয় না। সারা বছর নাম জানা নানা ফল ও ফুলে থাকে ভরপুর তার মূল কারণ চিরহরিৎ অরণ্যের অবস্থান ভৌগোলিক কারণে উষ্ণমন্ডলীর অঞ্চলের অবস্থিত। গ্রীষ্মকালীন এসব অরণ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সারা বছরই পাখীরা এসব অরণ্যের চারদিক কলকাকলীতে মুখর করে রাখে। গাছের উঁচু ডালে মহানন্দে দোল খায় হরেক রকম বানর। উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় ফুলে ফুলে নাচানাচি করে বেড়ায় সহস্র রঙ্গের ছটাযুক্ত বিচিত্র্য সব প্রজাপতি। ফুল আর প্রজাপতির বর্ণবৈচিত্র্যে চিরহরিৎ অরণ্যে সারা বছরই যেন বসন্ত খেলা করে। অজস্র প্রজাতির সাপ-ব্যাঙ থেকে শুরু করে চিরহরিৎ বনে দেখতে পাওয়া যায় জানা-অজানা লাখ লাখ জীবজন্তু ও কীট-পতঙ্গ।

চিরহরিৎ এ অরণ্যের নিবিড়-গহিন জঙ্গলে যে হাজার হাজার প্রজাতির প্রাণী রয়েছে তার বেশির ভাগের নাম আজও পর্যন্ত মানুষ জানে না বা জানতে পারেনি। সেজন্যই বিচিত্র এসব চিরসবুজ অরণ্যেগুলো ধরে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং বর্ণাঢ্য বুনো জীবনকে। পৃথিবীর মাত্র পাঁচ শতাংশ এলাকাজুড়ে চিরহরিৎ অরণ্যের বিস্তৃতি হলেও সারা দুনিয়ার প্রায় অর্ধেক প্রজাতির প্রাণী আর উদ্ভিদের খোঁজ পাওয়া যাবে এসব অরণ্যে। প্রবল শীতের সময় শীত প্রধান এলাকাগুলো থেকে লাখ লাখ অতিথি পাখির আগমন ঘটে চিরহরিৎ অরণ্যের জলাশয়, আফ্রিকা, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার ভেতরে চিরহরিৎ অরণ্যে। আফ্রিকার অরণ্যের ভেতরে অধিকাংশ স্থানের তাপমাত্রা এত বেশি যে তা মরুভূমির রূপ নিয়েছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চিরহরিৎ অরণ্যের অবস্থানগুলো অনেক ক্ষেত্রে ছন্নছাড়া। সেদিক থেকে চিরহরিৎ অরণ্যের আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, দক্ষিণ আমেরিকার চিরহরিৎ অরণ্যেকে।

আমাজান নদীকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এ রেইন ফরেস্ট-সত্যিকারের এক চিরহরিৎ অরণ্য। চার হাজার মাইল বিস্তৃত নদী আমাজানের জঙ্গল পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আবাস, লাখ লাখ বছর ধরে ক্রমবিকাশের ধারায় তৈরি হয়েছে। দীর্ঘতম এ চিরহরিৎ অরণ্যের জীব-জন্তুগুলো, হাজার হাজার বছর ধরে রেইন ফরেস্টে বাস করে আসছে বিভিন্ন প্রজাতির মানুষ। এসব মানুষ শিকার করে, মাছ ধরে এবং বনের টাটকা ফলমূল খায়। চিরহরিৎ অরণ্যে থাকতে থাকতে এসব মানুষ এখন অরণ্যেরই এক অংশে পরিণত হয়েছে। এদিকে চিরহরিৎ অরণ্য দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ অরণ্যগুলো ধ্বংসের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য কিংবা পরিবেশের যে সর্বনাশা ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তা মানুষের হিসাব-নিকাশ ও বোধ-বুদ্ধির বাইরে, এ অপূরণীয় ক্ষতি হয়তো মানুষের জন্য একটু দেরিতে হবে। কিন্তু অরণ্য ধ্বংসের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চিরহরিৎ অরণ্যের বিপুল বৈচিত্র্যের অধিকারী বাসিন্দাদের। এসব বাসিন্দার মধ্যে আছে লেমুর শ্লথ, শিম্পাঞ্জী, গরিলা, শিকারী বাজ, চিতা, বোয়া, সাপ, হাতি, প্যাঙ্গোলিন, গ্রে-প্যারট, বাঘ ইত্যাকার বর্ণাঢ্য প্রাণিকুল।

এ প্রাণিকুল মানুষের কোনো কাজে আসুক বা না আসুক অন্তত পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করত। কিন্তু মানুষ সভ্যতার নামে যে ধ্বংসযজ্ঞের কাজ শুরু করেছে তা এরই মধ্যে মানুষের পায়ে বুমেরাং হয়ে কুড়াল মারার সমান হয়ে যাচ্ছে। চিরহরিৎ অরণ্যের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষিপ্রগতির প্রাণী ছিল চিতা। ছিল বলা হচ্ছে, এ জন্যই যে, চিতা এখন প্রায় বিলুপ্ত প্রাণী। ব্রাজিল, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনার আমাজনের চিরহরিৎ অরণ্যের চিতার কথা বাদ দিয়ে আমাদের দেশের-সুন্দরবনের চিতার কথাই ধরা যাক। এক সময় সুন্দরবনে অসংখ্য চিতা ছিল, এখন সুন্দর চিতা বিলুপ্ত শুধু কয়েকটা বোধহয় কাগজে-কলমে কিংবা চিড়িয়াখানায় আছে। চামড়ার জন্য মানুষ এসব চিতাকে ধ্বংস করে চলেছে। চিতা বাঘের চামড়া অত্যন্ত মূল্যবান শৌখিন বিলাস দ্রব্য। মানুষের বিলাসিতার কারণে সভ্যতার যুপকাষ্ঠে বলি হয়েছে এ চিতা। সারা বিশ্বের বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় পান্ডার পরেই সম্ভবত চিতার উল্লেখ আছে। সুদৃশ্য চামড়ার কারণে চিতার মতো বিপন্ন চিরহরিৎ অরণ্যের এমারেন্ড গ্রিন ট্রি বোয়া অর্থাৎ সোজা বাংলায় অজগর, অজগরের চামড়া সুদৃশ্য হাত ব্যাগ, মানিব্যাগ ও প্যাকেজের বাঁধাই কাজে খুব মূল্যবান পণ্য হিসাবে গণ্য। মানুষের এ লোভের অনলে পুড়ে জীবন দিয়েছে লাখ লাখ অজগর। ধ্বংস হয়েছে অজগর বসবাসের মতো সুরক্ষিত বনাঞ্চল। বিঘ্নিত হয়েছে অজগরের প্রজনন। স্বাভাবিকভাবে অজগর এখন বিপন্নতার মুখোমুখি ভয়াবহভাবে।

চিরহরিৎ অরণ্যে শিকারি পাখিগুলোর দৌরাত্ম্য ছিল একসময় এখন নেই। এখন তার বাসিন্দাদের অনুকূল পরিবেশ, মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদায় তাদের ছেড়ে দিতে হচ্ছে নিজস্ব আবাস। সোনালি বাজ শিকারি ঈগল ইত্যাকার পাখিগুলো মূলত রেইন ফরেস্টের উঁচু বৃক্ষের মাথায় বসবাস করে। মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজনে কেটে নিয়ে যাচ্ছে উঁচু বৃক্ষ। ফলে কমে যাচ্ছে বাজ, বিল, শকুন, ঈগল ইত্যাদি পাখি। সোনালি বাজ আজ প্রায় বিরল, মিউজিয়ামের সোনালি বাজ দেখেই তৃপ্ত থাকতে হবে আগামী প্রজন্মের পাখিপ্রেমিকদের। চিরহরিৎ অরণ্যের সব চেয়ে জমকালো বাসিন্দা বাঘও আজ বিপন্ন প্রায়। মানুষ অনুধাবন করতে শুরু করে শেষ মুহূর্তে, বাঘকে না বাঁচালে আর গর্ব করার কিছু থাকছে না, তখনই তারা ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করে দিলো। ফলে গড়ে উঠল কিছু হাস্যকর অভয়ারণ্য, যার মধ্যে স্বাধীনচেতা বাঘকে প্রতিপালন করা অসম্ভব। এজন্যই দেখা যায় সুন্দরবনের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে খাঁচায় রাখলে হয়, সে মারা যাচ্ছে অনাহারে, কিংবা বদ্ধপরিবেশের কারণে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার গর্ব এ সুন্দরবন নামের চিরহরিৎ অরণ্যে, যা আজ লোভী মানুষের কুঠারাঘাতের শিকার, দিনকে দিন উজাড় হচ্ছে বনভূমি, রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা ঘুরে বেড়ানোর জায়গা পাবে কোথায়? মানুষের যে জায়গার বড় বেশি প্রয়োজন। হায় মানুষ! হায় তার প্রয়োজন!

বিশ্বব্যাপী চিরহরিৎ অরণ্যের বিপন্নতা রক্ষার জন্য যেমন আন্দোলন শুরু হয়েছে, তেমনি চিরহরিৎ অরণ্যের বাসিন্দাদের আদিম ও স্বাভাবিক অনুকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠার জন্য সৃষ্টি করা হচ্ছে অভয়ারণ্য। কাগজ-কলমের অভয়ারণ্য নয়-বাস্তবিক অভয়ারণ্য। উন্নত দেশের মানুষ যে আন্দোলন শুরু করেছে তা পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন, বিপন্ন প্রাণিকুলকে রক্ষার আন্দোলন। আমাদেরও উচিত এ পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন গড়ে তোলা। তাহলে সুন্দরবনের মতো দক্ষিণ এশিয়ার চিরহরিৎ অরণ্য যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি রক্ষা পাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বর্ণাঢ্য বৈচিত্র্যময় চিরহরিৎ অরণ্যের বাসিন্দা।

পৃথিবীর জন্য, পৃথিবীর পরিবেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সারা বিশ্বের চিরহরিৎ অরণ্যেগুলো আজ ভয়ংকর বিপন্নতার মুখোমুখি। বসতি স্থাপনকারীরা বনজঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে ফেলছে। তারা সংকীর্ণ নিজস্ব স্বার্থে খামার বাড়ি তৈরি করে দখল করছে বনভূমি। হ্রদ তৈরি করছে কৃত্রিম পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য, হিতেবিপরীত হয়ে মারা পড়ছে গাছপালা। মূল্যবান ধাতুর খোঁজে খনিতে খোঁড়াখুঁড়ি, তেল উত্তোলনের ড্রিলিং রিগ, পরিবহনের জন্য রাস্তাঘাট বসবাসের জন্য আবাসস্থল ইত্যাদির কারণে বৈচিত্র্যময় চিরহরিৎ অরণ্যগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মানুষ নিজের প্রয়োজনে, সভ্যতার উন্নয়নের জন্য প্রতিমিনিটে ৮০ একর চিরহরিৎ অরণ্য সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করছে। যদি এ নষ্ট করার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী ক’সালে চিরহরিৎ অরণ্যে তার বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি এবং আবশ্যক জীবনসহ পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত