ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাঙালির সমাবর্তন

সামছুল আলম দুদু এমপি, রাজনীতিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য
বাঙালির সমাবর্তন

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি একটি ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল দিন। এ দিন ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বাধীন স্বদেশ ভূমিতে বীর বেশে তিনি ফিরে এলে গোটা জাতি উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করি। বিজয়ী জাতি উল্লাসে ফেটে পড়ে। সৃষ্টি সুখের এ উল্লাসে কোনো ভণিতা ছিল না। আবেগপ্রবণ বাঙালি জাতির লালিত স্বপ্ন যখন ধরা দিয়েছে, তখন কী ঘরে বসে থাকতে পারে কেউ? স্বজন হারানোর এক বুক বেদনা নিয়েই রাস্তায় নেমে এসে বিজয় কেতন উড়াতে। কিন্তু একটি অপূর্ণতা গোটা জাতিকে যেন শূন্যতায় ভোগতে হচ্ছিল। কী সে শূন্যতা? সে শূন্যতা হচ্ছে, বিজয় উল্লাসে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি যার জন্য স্বাধীনতা যার জন্য মহান বিজয়; যিনি একটি জাতি রাষ্ট্রের জন্মদাতা তিনি যদি বিজয় মুহূর্তে অনুপস্থিত থাকেন, তবে তো বাঙালির বিজয় উল্লাস তাৎপর্যহীন এবং বর্ণহীন থাকে। যিনি সারা জীবন বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করে গেছেন, যিনি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করে রাজনীতির মাঠে কাটিয়েছেন। সে মহান নেতা যদি অনুপস্থিতি থাকেন, তবে কি বিজয়ের পূর্ণতা আসে? জাতির অধীর অপেক্ষা কখন আসবেন প্রিয় নেতা। দীর্ঘ সংগ্রাম, লড়াইয়ের পর একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথ ও তার আদর্শের উপাসক হিসেবে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়, প্রায় ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম বিসর্জিত হয়। এমন মহান আত্মত্যাগ ইতিহাসে খুবই বিরল ঘটনা। বাঙালি জাতি এ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। এমন মহান মানুষের জন্ম না হলে আমরা কোনো দিন লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারতাম না। বস্তুত তিনিই আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন।

১৯৭০ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা শাসক জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। তৈরি হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন। মূলত সে ভাষণেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান। ঐতিহাসিক সে ভাষণ আজ বিশ্বে শ্রেষ্ঠ ভাষণের একটি হিসেবে মর‌্যাদা লাভ করে। আমাদের গর্ব এমন ভাষণ বাঙালি জাতিকে বিশ্ব মর‌্যাদায় অভিসিক্ত করেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। কিন্তু গ্রেপ্তারের আগ মুহূর্তে তিনি ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে যান।

সশস্ত্রযুদ্ধ শুরু হয় ২৫ মার্চের রাত থেকেই। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙালি সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করে স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয় বঙ্গবন্ধুর ডাকে। তুমুল জনযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই যার যা কিছু আছে, তাই নিয়েই শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনী বর্বর-নির‌্যাতন চালিয়ে বিশ্ব বিবেককে মর্মাহত করে। রাজধানী ঢাকার মানুষ গ্রামে আশ্রয় নিতে থাকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসংখ্য যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বেরিয়ে যায়। এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ভারত সশস্ত্র ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে। ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ৯টি সেক্টরের অধীনে যুদ্ধে অংশ নেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীও প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সহযোগিতা করে। বঙ্গবন্ধুর নামের জাদুতেই বাঙালি শক্তিশালী পাকিস্তানি সৈনিকের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে সমর্থ হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। যা আগে উল্লেখ করেছি। কিন্তু বিজয়ের দিন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে নতুন সরকার যাত্রা শুরু করে। ২৬ মার্চ থেকেই অস্থায়ী সরকারের যাত্রা শুরু হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ এপ্রিল ১৯৭০ মেহেরপুরের আম্রকাননে মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সরকারি অস্থায়ী কার‌্যালয় স্থাপিত হয় কলকাতায়।

যুদ্ধে বিজয় লাভ করার পর রাজধানী ঢাকায় সরকারি কাঠামো স্থাপিত হয় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে। বাঙালি জানে না তখনও প্রিয় নেতার ভাগ্যে কী ঘটেছে। বিজয়ের ২৩ দিন পর অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে আন্তর্জাতিক চাপে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমাদের বিজয়ের মাত্র কয়েকদিন আগে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান গদিচ্যুত হন। প্রেসিডেন্টের পদে অধিষ্ঠিত হন পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনিই বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তির পর অপ্রত্যাশিতভাবে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে তার তদানীন্তন সংবিধান উপদেষ্টা ড. কামালকে সহযাত্রী করে প্রথমে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন ভুট্টো। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছলে একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান ঘটে। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্যের অনিশ্চয়তাপূর্ণ ১০টি মাসের অবসান ঘটে। দীর্ঘ ভ্রমণের পর বঙ্গবন্ধু অনেকটাই ক্লান্ত ছিলেন। তিনি বেঁচে আছেন এবং গৌরবান্বিত বিজয়ীর মতো বেঁচে আছেন, তা তিনি অনুভব করছিলেন। লন্ডনে উৎফুল্ল জনতা তাকে ঘিরে ধরতে অপেক্ষায় ছিল। বিমান থেকে বীর বেশে নেমে তিনি লন্ডনের ক্যারিজেস হোটেলের ১১২ নম্বর স্যুটে ওঠেন। সেই স্যুটটি যেন ২ দিনের জন্য বাংলাদেশের রাজধানীতে পরিণত হয়েছিল। তিনি তার প্রিয় দেশবাসীর কাছে ফিরে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। এদিকে স্বাধীন দেশের নাগরিক জাতির পিতার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত। অবশেষে সেই দিনটি এলো। ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন। এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। উল্লাসে ফেটে পড়ে বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধু বাঙালির কাছে ফিরে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। যুদ্ধে স্বজন হারানোর বেদনার কথা যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রিয় দেশের পরিস্থিতি অবলোকন করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। বাংলায় আকাশ-বাতাস বিজয়ের ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে বাঙালি জাতি। বাঙালি জাতি প্রিয় নেতাকে কাছে পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পায়। রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের জন্য যে মহান নেতা এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তার উপস্থিতিতে বাঙালি অসীম সাহসে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ঘটে যায় জাতিসত্তার সমাবর্তন। যুগে যুগে ১০ জানুয়ারি আমাদের দোলা দিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষিপ্র গতিতে তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা জানাই সব শহীদের প্রতি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত