ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শিশুকাল থেকে নারী হওয়ার যন্ত্রণা

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ, সাবেক প্রকৌশলী ও শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার
শিশুকাল থেকে নারী হওয়ার যন্ত্রণা

আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশু ধর্ষণ, অপহরণ ও খুনের ঘটনা। বড়দের কলহের কারণে প্রাণ যাচ্ছে অসহায় শিশুদের। পারিবারিক বিবাদ, পরকীয়ার প্রতিশোধের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে অবুঝ শিশুরাই। কখনও সন্তানসহ মাকেই আত্মহত্যা করতে দেখা যাচ্ছে। প্রতিশোধ নিতে প্রতিপক্ষের শিশুকে হত্যা করার ঘটনা বিরল নয়। শিশুকে ধর্ষণ করার মতো অপকর্মে হৃদয় কাঁপে না অনেক পাষণ্ডের। ধর্ষণের কথা যাতে গোপন থাকে সেজন্য গলাটিপে হত্যা করা হয় ধর্ষিতা শিশুকে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নির্মম এক ঘটনা এমন তথ্যের সত্যতারই প্রমাণ দেয়। গত বছরের ১৫ নভেম্বর নিখোঁজ হওয়া ৫ বছরের শিশুকন্যা আলিনা ইসলাম আয়াতের মা-বাবা নিখোঁজের ১০ দিন পরে জানতে পারেন তাদের মেয়েকে হত্যার পর টুকরো করে ফেলে দেয়া হয়েছে। বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে প্রতিবেশী যুবক শিশু আয়াতকে অপহরণের পর ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ না পেয়ে শিশুকে ধর্ষণ শেষে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ বস্তাবন্দি করে বাড়ির আঙিনায় পুতে রাখে। তাছাড়া রাজধানীর রায়েরবাজারে গত ৮ ডিসেম্বর পারিবারিক কলহের কারণে ৩০ বছরের মা হাসিনা বেগম তার ৩ বছর ও ৬ মাস বয়সি দুই শিশুসস্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেন মা। এভাবে শিশুর প্রতি অত্যাচার-অবিচারের খতিয়ান বেশ লম্বা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, গেল বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৪৩৯ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০৪ জনের বয়স ৬ বছরের নিচে এবং ৭৯ জনে শিশুর বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। এছাড়া নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে ৯৭৫ জন শিশু। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট ৫০টি শিশু অপহরণের শিকার হয়েছে, এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৪৪ জন। একটি টেলিফোনিক জরিপের ভিত্তিতে বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ জানায়, গেল বছর শুধু মে মাসে ৩১ দিনে দেশের ৫৩টি জেলায় ১৩ হাজার ৪৯৪ জন নারী ও শিশু সহিংসতার বলি হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৯ জন শিশু ও কিশোরী। ১৩টি মেয়েশিশু ও ৬টি ছেলেশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ১৮ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ত্রাণ নিতে গিয়ে যৌন হয়রানিতে পড়েছে ৩ জন মেয়ে। আর অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি, এর মধ্যে ১৯ জনই মেয়ে। ধর্ষণের মতো গর্হিত কাজে শুধু লম্পট, বখাটে কিশোর-যুবকরাই জড়িত নয়, ধর্ষকদের মধ্যে রয়েছে শিক্ষিত যুবসমাজ, রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষকসহ নানা বয়সি ও শ্রেণিপেশার মানুষ। কলেজ, ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া একশ্রেণির বর্বর ছেলেরাও ধর্ষণ করে চলেছে অসহায় শিশুদের। নিকটাত্মীয়, পরিবারের সদস্য, সহকর্মী, যানবাহনের চালক-সহকারী, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, শিক্ষকের নাম উঠে আসছে ধর্ষকের তালিকায়।

সমাজটা বড্ড অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। নগর জীবনের ব্যস্ততার কারণে মা-বাবা তার সন্তানকে বঞ্চিত করছেন স্নেহ-আদর-ভালোবাসা, উপযুক্ত শাসন থেকে। দাদা-দাদি, চাচা-চাচির মতো নিকটাত্মীয়ের সান্নিধ্যবঞ্চিত শিশু-কিশোর ঘরের মাঝে একাকীত্বে ভোগে। শিশু-কিশোরের মনোজগতে বিশাল শূন্যতা বাসা বাঁধে। তারা খুঁজে নেয় বাইরের এক অচেনা-অজানা জগৎ। সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিপথগামী বন্ধু-বান্ধবের সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। মাদকের অবাধ বিস্তার ধর্ষণের মতো অপরাধ বাড়িয়ে তুলতে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। আকাশ সংস্কৃতি ও তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এবং এর অপব্যবহার শিশু-কিশোরের চরিত্রকে প্রভাবিত করছে। দেশে কোথাও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ নেই বলে অবসরে ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি, ভিডিও দেখে এবং ফেইসবুকে বখে-যাওয়া বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগের অবাধ সুযোগে শিশু-কিশোররা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দেখে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা ও খেলাধুলার ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকে পড়ছে নানা নেশায় যা তাদের চরিত্র গঠনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবই শিশুর ওপর অত্যাচারের প্রবণতা বাড়িয়ে তুলছে। প্রতিনিয়ত পারিবারিক বিরোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসার বলি হচ্ছে অবুঝ শিশুরা। রাস্তাঘাটে, চলন্ত বাসে এমনকি নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুরা ধর্ষিত হচ্ছে। নিজ মা-বাবা, নিকটাত্মীয়ের কাছেও আজ শিশুরা নিরাপদ নয়। কখনও জন্মদাতা পিতার হাতেও শিশুসন্তানকে যৌননিপীড়নের শিকার হওয়ার মতো অমানবিক ঘটনা ঘটছে কোথাও। নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে বাদ যাচ্ছে না প্রতিবন্ধী শিশুরাও। ৪ থেকে ৫ বছরের অথবা এর চেয়ে কম বয়সের শিশুকে ধর্ষণেরও নজির রয়েছে এ দেশে। ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, হত্যার পর লাশ গুমের ঘটনাও বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে একশ্রেণির লোকের টার্গেটে পরিণত হয়। শিশুদের ওপর বলপ্রয়োগ করে, ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করা সহজ। কর্মজীবী শিশু, গৃহকর্মীরা ধর্ষণের বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এমনকি ওদের দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করাও সহজ। যে বয়সে সমাজের প্রতিটি শিশু মানুষের স্নেহ-ভালোবাসা, আদর-যত্ন পেয়ে বেড়ে ওঠার কথা সেই বয়সে তারা হচ্ছে জিঘাংসার বলি। অনেক দিন আগে ওই যে ৭ থেকে ৮ বছরের বুশরা, গায়ের হাওয়া জলে বেড়ে উঠছিল অনেক স্বপ্ন নিয়ে, ধর্ষকের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে দৌড়ে ঝাঁপ দিয়েছিল পুকুরে, সাঁতার না জানায় ডুবে মরে গেল সবার অলক্ষ্যে, বাঁচা তার হলো না, তার মা-বাবা তাকে জীবিত উদ্ধার করতে পারলেন না। বুশরার মা-বাবা কী করে ভুলে যাবেন, তাদের সন্তান হারানোর শোক! আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো এক পাষ- সদস্যের কাছে আশ্রয় চেয়ে তার হেফাজতেই কিশোরীকে ধর্ষণের শিকার হতে হলো!

এর আগে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তদের দণ্ড প্রদান করে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আদালত। শিশুকে যৌননিপীড়নের মামলায় সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার এক ব্যক্তিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থীকে যৌনহয়রানির অভিযোগে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সাম্প্রতিক সময়ে শিশু ধর্ষণের ভয়াবহ বিস্তার রোধে শিশু ধর্ষণকারীকে কেন মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলে ১৬ বছরের নিচে কেউ ভিকটিম হলে সেক্ষেত্রে ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রণয়ন করায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না, তা জানতে চেয়েছেন আদালত। ধর্ষণের ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে সেক্ষেত্রে আইনে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবন সাজার যে বিধান রয়েছে, সে যাবজ্জীবন সাজা উঠিয়ে দিতে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, তাণ্ডও জানতে চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, নারীদের স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষামূলক যন্ত্র ‘অ্যান্টি রেপ ডিভাইস’ সরবরাহের বিষয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ।

শিশু অধিকার সনদে বাংলাদেশ সাক্ষর করেছে ১৯৮৯ সালে। কিন্তু দীর্ঘ ৩৩ বছর পার হয়ে গেলেও শিশুর জন্য রাষ্ট্র বা সমাজ তেমন নিরাপদ হয়নি। নৈতিক অবক্ষয়, পরকীয়া, সাইবার দুনিয়ার প্রতি নিয়ন্ত্রণহীন আসক্তি, সামাজিক বিশৃঙ্খলায় শিশুর জীবনই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফেইসবুকে ছোটবড় সবার অবাধ পদচারণায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে যুবসমাজের জীবন, তারা অভ্যস্ত হচ্ছে মাদক সেবনে। এর প্রভাব পড়ছে তাদের চরিত্রে, সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে। বাড়ছে কিশোর অপরাধ, অস্বাভাবিক যৌন প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অথচ শিশু-কিশোরদের চরিত্র গঠনে নেতিবাচক প্রভাবে যে ধর্ষণের বিস্তার তা প্রতিরোধে তেমন কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে না। এমন কি ধর্ষণের সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় এ ধরনের অপরাধ অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে। শিশু ধর্ষণ এবং শিশুর প্রতি যেকোনো ধরনের নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ পেতে সামাজিক অস্থিরতা দূর করতে হবে। দেশে সুশিক্ষা ব্যবস্থা, সুস্থ সামাজিক পরিস্থিতি ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে। শিশুদের সাইবার দুনিয়ায় অবাধ প্রবেশ ঠেকাতে হবে। মাদকের ব্যবহার রুখতে হবে যেকোনো মূল্যে। নিম্নবিত্তের কর্মজীবী নারীদের ঘরে তাদের সন্তানদের সুরক্ষা দিতে হবে। কর্মস্থলে শিশু-কিশোরীরা ধর্ষণের শিকার হয়, তাই শিশুদের কর্মে নিয়োগ বন্ধ করে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। ধর্ষিতা ও তার পরিবারকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আইনি সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশে ধর্ষণের শাস্তির জন্য যে আইনি বিধান রয়েছে তাতে ধর্ষিতাকে ধর্ষণের প্রমাণ করতে হয়। আলামত সংগ্রহ এবং যেসব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ধর্ষিতাকে যেতে হয় তাও কঠিন। ধর্ষণের ব্যাপারে ধর্ষিতাকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদও শিশু ও নারীর জন্য পীড়াদায়ক। মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিও ধর্ষণকে উৎসাহিত করে। শিশু ধর্ষণের ঘটনার ভয়াবহতাকে জাতীয় সংকট হিসেবে বিবেচনা করে দ্রুত সম্ভব অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচারসম্পন্ন করতে হবে। ধর্ষিতা নয়, ধর্ষককে নিরাপরাধ প্রমাণ করতে হলে ধর্ষিতার ওপর শারীরিক ও মানসিক চাপ কমবে। ধর্ষণ প্রতিরোধে জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণসহ শিশু ধর্ষণ ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আদালত কমিশন গঠনের যে নির্দেশ দিয়েছেন সেটা দ্রুত বাস্তবায়িত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে নিতে হবে সমন্বিত পদক্ষেপ। শিশু ও নারী ধর্ষণ প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও দ্রুত বিচার নিশ্চিতের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। নারী হয়ে জন্ম নেয়ার যন্ত্রণা শিশুকাল থেকে আর যেন কাইকে বইতে না হয়।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত