প্রতিবছর ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসজুড়ে চলমান থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভর্তি কার্যক্রম। একশ্রেণি থেকে উত্তীর্ণ হয়ে অন্য শ্রেণিতে অংশ নিতে প্রয়োজন হয় নতুন ভর্তির। ভর্তিটা রেখেছে শুধু নামে, কাজেকর্মে চলে বাণিজ্য। এ বাণিজ্যের মুখোমুখি হতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের। বছর শেষ হতেই ভর্তি ফি, টিউশন ফি, আরও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন খাত দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের থেকে হাতিয়ে নেয় হাজার হাজার টাকা। এইসব টাকা নিজেদের পরিবারের খাতে ব্যয় করা ছাড়া আর কোনো কাজে আসছে না তাদের। সরকার থেকে উপযুক্ত বেতন পেয়েও ভর্তি কার্যক্রমের নামে টাকার রসিদ ধরিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের থেকে হাতিয়ে নেয় অর্থ। নিয়মনীতির বেরিকেট ডিঙিয়ে এমপিওভুক্ত যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের অনিয়মের কোনো শেষ নেই। সরকার এমপিওয়ের মাধ্যমে শিক্ষকদের পুরো বেতন দিচ্ছে, দালান-কোঠা নির্মাণ করে দিচ্ছে, উপবৃত্তি প্রদান, বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, শিক্ষা উপকরণসহ শিক্ষার্থীদের নানাবিধ সরঞ্জাম প্রদান করলেও এসব খাত দেখিয়ে শিক্ষালয়গুলোকে বাণিজ্যালয় পরিণত করেছে কিছু অসাধু চক্রের মানুষ। এইসব অর্থ আবার কমিটির মধ্যেও যায়। শুধু এই নয়, ক্লাসের পাঠদানে চলে গল্পের আসর। ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপ চাপিয়ে দেয় প্রাইভেটে ভর্তি হওয়ার জন্য। একই ক্লাস, অথচ কত কি ব্যবধান করে ফেলে ক্লাস এবং প্রাইভেটে। মানুষ গড়ার কারিগরগুলো যদি অমানুষের কাতারে পা বাড়ায়, সেখানে সভ্যতা বলতে কিছুই থাকে না। এ জন্যই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা দুরাবস্থার মধ্যে নেমে এসেছে। বেড়েছে অসভ্যতার জয়গান। এ দোষ কার ঘাড়ে যাবে? শিক্ষার্থীদের? কখনোই নয়, তারা যেমনটা শিখেছে, তেমনটাই ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ একটি স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণয় হবে। এই আশায় সরকারের কত কী নানা পদক্ষেপ। সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এ যেন হয়ে ওঠেছে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।’ শিক্ষার্থীদের ওপর শিক্ষকদের যেন কোনোই দায়বদ্ধকতা নেই। বর্তমানে দাখিল ও মাধ্যমিকের অনেক শিক্ষার্থী ইংরেজি পড়া তো দূরের কথা বাংলা পড়তেও আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। তাহলে বুঝা যায়, কতই সুক্ষ্মভাবে চালিয়ে নিচ্ছে নিজেদের কার্যক্রম।
এমনটা যে শুধু দাখিল ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হচ্ছে তা কিন্তু নয়, প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে আরেক ফাঁকিবাজি। অফিসরুমে বসে বসে ফ্যানের বাতাস খেয়ে বছর কাটানো ছাড়া তেমন কোনো কাজ নজরে আসছে না সচেতন অভিভাবকদের চোখে। পাঠদানে চলছে অন্যমনষ্কতা। অলসতাময় শিক্ষা কার্যক্রমের কারণে যারা সচেতন অভিভাবক রয়েছে, তারা তাদের সন্তানদের কিন্ডারগার্টেন স্কুল অথবা ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাকার্যক্রমের দুরাবস্থার কারণে প্রতিনিয়ত বিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষার্থী উদাও হয়ে যাচ্ছে। ৫ম শ্রেণিতে যারা আছে, তাদের থেকে ফাঁকিবাজি করে হাতিয়ে নেয় অর্থ। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বাংলা ও গণিত/ইংরেজি ক্লাস সম্পূর্ণ হয়; কিন্তু এ সম্পূর্ণ হওয়া ক্লাসগুলো পুনরায় আর ক্লাস হয় না। অথচ, এটা নাকি কোচিং। কোচিংয়ের নাম করে ক্লাস সম্পূর্ণ করিয়েও অর্থ হাতিয়ে নেয় অবুঝ শিশুদের থেকে।
মানসিকতার পরিবর্তন হলে হয়তো প্রাথমিকের এ ঘোর অন্ধকার কেটে যাবে। তবে, তবে তাই যেন হয়। মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন এলে অনেক অসম্ভবও সম্ভব হয়ে ওঠে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় শক্তি ফিরে আসুক সহজলভ্যতার মধ্য দিয়ে। বেড়ে যাক সচেতনতা। তবেই গড়ে ওঠেবে একটু আলোকিত বাংলাদেশ। গ্রামভিত্তিক যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোও যেন বন্ধ করে দেয়, তাদের বাণিজ্য পরিচালনা। আমার দেখা গ্রামীণ পরিবেশে এটা একটি ভয়াবহ বাণিজ্যালয়।
* হাতিয়া, নোয়াখালী