ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কালের কড়চা

বিশ্বের বিভাজন দূর করার প্রচেষ্টায় ভারত

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, [email protected]
বিশ্বের বিভাজন দূর করার প্রচেষ্টায় ভারত

বিশ্ব আন্তর্জাতিক বিরোধপূর্ণ অবস্থার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। যদিও এ বিরোধ নতুন নয়। তবে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে এ বিরোধ থাকাটা মানবসভ্যতার জন্য মহাকলংকের। বিশ্ব নেতারা এটা উপলব্ধি করলেও বিরোধ কমিয়ে আনা অথবা নিরসন করার ইতিবাচক কোনো উদ্যোগ কেউ গ্রহণ করছে না। এমনি বিরোধপূর্ণ সময়ে বিশ্বের ২০টি অর্থনৈতিক শক্তির জোট জি-২০-এর চলতি বছরের সভাপতির দায়িত্ব লাভ করেছে ভারত। শক্তিশালী ভূরাজনৈতিক মেরুকরণ উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম বিভাজন, চ্যালেঞ্জ এবং বিশ্ববাসীর প্রত্যাশার নিরিখে ভারতের সভাপতির দায়িত্ব হাতে নেয়া কঠিন এবং ব্যতিক্রম বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। তিনি বর্তমানে জি-২০-এর প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘ব্যাপক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা ও শক্তির মধ্যে সেতুবন্ধন রচনায় ভারতের সামর্থ্য ও দক্ষতার বিষয়ে আমরা আশাবাদী। তিনি আরও বলেছেন- ‘বিভক্ত বিশ্বকে সফলভাবে কাছাকাছি নেয়ার উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালের জি-২০ সম্মেলনের স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে এক বিশ্ব, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ। উল্লেখ্য, বিগত ৩টি বছর কোভিড-১৯ মহামারির ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত হয়েছে। ভোগ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি, বিশ্বখাদ্য সংকট জনজীবনে হুমকির সৃষ্টি করছে। এমনি সংকটময় পরিস্থিতিতে বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। ভারত সেই ঐক্যের কথা বিবেচনা করে জি-২০-এর কর্মসূচি নির্ধারণ করেছে। যার নেতৃত্বে রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। গত কয়েক বছরে ভারতের বৈশ্বিক অবস্থান আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব, আঞ্চলিক সংলাপ ও উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য আশার আলো ছড়িয়েছে। ভারত ব্রিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) সদস্য হিসেবে কোয়াডে যুক্তরাষ্ট্র জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কাজ করেছে তা ছাড়া সাংহাই কো-অপারেশন এসপিওতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ অবদান রেখে চলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আফ্রিকা, ঐক্যের প্রশ্নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। তবে সার্ক তেমনভাবে কার্যকর নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নিবিড় ঐক্য স্থাপনে সার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারলে ভারতের লক্ষ্য বাস্তবায়নে অনেকটাই সহজ হতো।

সাম্প্রতিক বিশ্ব বিবেচনায় জি-২০ এমন একটি অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম যেটি বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতিকে গতিশীল করতে সক্ষম হবে।

এই সংগঠন জি-৭ সহ অন্যান্য অর্থনৈতিক জোটের সঙ্গে সমান অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এর পাশাপাশি বিভাজনের বীজও রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেটা প্রমাণ করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঐকমত্যের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে দেশটি পররাষ্ট্র নীতিতে। সেই আলোকে জি-২০-এর সেøাগান ভারতীয় ঐতিহ্যগত প্রাচীন দর্শনের আলোকপাত ঘটেছে। সে দর্শনটি হচ্ছে- বৈদান্তিক দর্শন। বৈদান্তিক দর্শনই মানবিক উৎকর্ষের ধারক। মানবিক উৎকর্ষ ছাড়া মানব-জাতির ঐক্য অসম্ভব। এখানে একটি কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে যখন করোনা মহামারি ভয়ংকর হয়ে উঠছিল, তখন প্রতিরোধ ব্যবস্থায় নরেন্দ্র মোদি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছিলেন। চিকিৎসাসেবাকে জনগণ-কেন্দ্রিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে মহামারি মোকাবিলায় ভ্যাকসিন ও অক্সিজেন দিয়ে সারা পৃথিবীকে সহযোগিতা করেছে ভারত।

প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারত সমতাকে প্রাধান্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। জি-২০-এর কর্মসূচিকে এমনভাবে প্রসারিত করতে হবে, যাতে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক সংকট সামলাতে সক্ষম হয়। ভারতীয়দের চরিত্র রূপান্তরে মোদি তার নীতিকে অনন্য আদর্শে উপস্থাপন করেছেন। নৈতিক ভিত্তিতে চরিত্রের রূপান্তর ঘটলে দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনের ভোল আমুল পাল্টে যাবে। ফলে তারা সবেগে নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে এগিয়ে যেতে পারবে। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সহানুভূতির উদয় হলে প্রশাসন সচল হবে, সব কাজকর্মই দ্রুতসম্পন্ন হবে এবং জাতিও সার্বজনীন কল্যাণের লক্ষ্যে দ্রুত এগিয়ে যাবে। ভারতের মতো দেশে যেখানে উন্নতি কয়েক শতাব্দী ধরে থমকে আছে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে যে দেশের কোটি কোটি মানুষ একটু সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় হা-পিত্যেশ করে বসে আছে, স্বামী বিবেকানন্দের জ্বালাময়ী ভাষায় যারা ‘পশুর মতো জীবনযাপন করছে, সেখানে চিন্তা, চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গির এই ইতিবাচক পরিবর্তন এক মহাসম্পদ হয়ে উঠবে। এ সত্য হৃদয়াঙ্গম করে সেই সত্যের ডাকে যথোপযুক্ত সাড়া দিতে পারলে প্রশাসকদের চরিত্র ও কর্মদক্ষতা এমন নিখুঁতভাবে বিকশিত হবে যে, তাদের জীবন ও কর্ম আর উৎসাহে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।

এ ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মহত্ব সাধারণভাবে বিশ্বের সব নারী-পুরুষেরই আয়ত্ত করা দরকার; কিন্তু আরও বেশি প্রয়োজন তাদের, যারা নিজ নিজ দেশে প্রশাসনের দায়িত্বে আছেন অথবা থাকবেন। এ মহানুভবতা ও উদারচিত্ততা চরিত্রে এলে নীতি হিসেবে সেবাভাব ব্যাপকভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে মানব জাতির অন্ধকার ও নিরানন্দময় জীবন আলোকিত করে তুলবে এবং নাগরিকদের আধ্যাত্মিক জীবন উন্নত করবে। সারা বিশ্বের নাগরিকরা একই আলোয় আলোকিত হবে; নরেন্দ্র মোদি এমন দৃষ্টিভঙ্গিতেই বিভাজন দূরীকরণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সমাজের ভৌগলিক আয়তন ও জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা দরকার। সেটি সফলভাবে করতে পারলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হবে। পাশাপাশি আত্মস্বার্থ সম্পর্কে মানুষের চেতনার বিস্তার ঘটিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্বের সাম্প্রতিক বিভাজন এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছে, যেমন এক রাষ্ট্রের শত্রুভাবাপন্ন অন্য রাষ্ট্রের বন্ধু হয়ে উঠছে। যেমন ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশ, পাকিস্তান শত্রু ভাবাপন্ন হলেও ভারতের অপর বন্ধু রাশিয়ার শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্র আমেরিকা। আমেরিকার সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অন্য এক উচ্চতায় পর্যবসিত এক সময় মানে ভারতের স্বাধীনতার পর সবুজ বিপ্লবে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার কথা কারও অজানা নয়। গভীর সম্পর্ক ছিল ভারতের সঙ্গে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনকালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। মূলত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পাশাপাশি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধও চলছিল। সে যুদ্ধে পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। অবস্থা ও সময়ের ব্যবধানে বন্ধু শত্রু হয়ে যায়, শত্রু বন্ধু হয়ে যায়। বর্তমানে ভারত-জি-২০-এর নেতৃত্ব গ্রহণ করে বিশ্ব বিরোধ মেটানোর যে তাগিদ অনুভব করছে বাস্তবতার নিরিখে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, আপেক্ষিক সত্য নয়, উচ্চতর সত্যে উপনীত হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মানবীয় পথে মানব বিকাশের ধারণা উপস্থাপন করেছেন। এই ধারণায় মানবিক মর্যাদা ও উৎকর্ষ অর্জনের পথকে সুগম করবে। জি-২০-এর সম্মেলনকে সামনে রেখে এমন এক সেøাগান নির্ধারণ করেছেন, যেটি বিশ্ব মানব চেতনাকে বিকশিত করবে বলে বিশ্বাস করা যায়। বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অপেক্ষাকৃত অনুকূল বাতাবরণে মানব জাতি যখন সঠিক মানব বিকাশের সমস্যাটির সঙ্গে লড়াই করছে, তখন অতীতের এই যে প্রাপ্তি তার মূল্য অনেক বেড়ে যায়। এ বিশেষ দিকটির প্রতিই ভারত বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। এ সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে, বিশ্বের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, যেমন শ্রমজীবী শ্রেণি, উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের ধর্মীয় জীবন থেকে এক অমূল্য সম্পদ লাভ করেছে এবং সম্পদের সেই স্বর্ণপেটিকা নিহিত তাদের সংস্কৃতিতে, তাদের মনুষ্যত্ত্বে।

পৃথিবীর জনসাধারণের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে। পৃথিবীর মানব সমাজে এমনও কেউ থাকতে পারেন, যারা ধর্ম কথাটিকেই পছন্দ করেন না। কিন্তু এমন একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি পূর্ণাঙ্গ মানব বিকাশের দর্শন ও কর্মসূচির বিরোধিতা করবেন। মানুষের জীবনের উৎকর্ষতা বাড়ানোর প্রয়োজন সব মানুষই উপলব্ধি করে। এ ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল ধর্মীয় ও সামাজিক মতাদর্শের মানুষই একমত। এ বিশ্বাসটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রয়েছে, বিশ্বাসের এ জায়গা থেকে তিনি জি-২০-এর কর্মসূচির ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করে মানব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একজন দরিদ্র ব্যক্তি যেমন ধনী ব্যক্তিকে ঈর্ষা করেন, তেমনি একটি দরিদ্র দেশ একটি ধনী দেশকে ঈর্ষা করে। আবার একজন ধনী ব্যক্তি বা ধনী একটি ধনী রাষ্ট্র ততোধিক বিত্তবান ব্যক্তি বা প্রভাবশালী রাষ্ট্রকে ঈর্ষা করে এমন পরিস্থিতিতে বিভাজন বা বিচ্ছিন্নতা বোধই পুষ্ট হতে পারে। বাড়তে পারে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনাচার। অর্থ এবং বিত্তের ভিত্তিতে আমরা কোনো কিছুর মূল্য নিরূপণ করে থাকি, আসলে মানুষের মূল্যেই সবকিছুর মূল্য মানুষই সব মূল্যবোধের কেন্দ্রবিন্দু। এ চেতনাকে ধারণ করে জি-২০-এর কার্যক্রম পরিচালিত করার যে পদক্ষেপ মোদি গ্রহণ করেছেন, এতে বিশ্ববিভাজন দূর হয়ে যাবে। বিশ্ব বিভাজন দূর হলে শান্তিময় বিশ্ব গড়ে উঠবেই এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত