ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মতামত

দ্বীপাঞ্চলের জনজীবন

এম এ জিন্নাহ, কলামিস্ট, কবি ও ছড়াকার, [email protected]
দ্বীপাঞ্চলের জনজীবন

জীর্ণবস্ত্রে শীর্ণদেহে এখনও ভিন্ন কিছু মানুষ আছে এদেশের উপকূলে। যাদের নেই কোনো উৎকৃষ্ট প্রাপ্তি। ডিজিটাল বাংলাদেশের মানুষ স্মার্ট বাংলাদেশের সম্মুখে এগিয়ে চলেছে আপনার হাসি হেসে। অথচ, দ্বীপাঞ্চলের মানুষের আত্মা-হাহাকারিত অফুরন্ত ইচ্ছেগুলো মিশে যায়, কতশত রঙিন ইচ্ছেপূরণের পদতলে। নেই নেই কিছুই নেই, যা আছে তা শুধু উপস্থিতির নাম মাত্র। আসুন আজ জেনে নেব একটি উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চলের জনজীবনের কথা। দ্বীপটি নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া। যা মেঘনা নদীর বুকে এবং বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত। এই দ্বীপের আয়তন ২ হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটার বা ৮০০ বর্গমাইল। এটি আয়তনের দিক দিয়ে নোয়াখালী জেলার সবচেয়ে বড় উপজেলা। দ্বীপাঞ্চল এ উপজেলাটি নোয়াখালী জেলার বেশকিছু খণ্ড দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এর উত্তরে রয়েছে- মেঘনা নদী ও সুবর্ণচর, উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে মেঘনা নদী ও লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলা, পশ্চিমে হাতিয়া চ্যানেল ও ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলা, দক্ষিণে রয়েছে সুবিশাল বঙ্গোপসাগর, খণ্ডিত চরাঞ্চল। উল্লেখযোগ্য রয়েছে- দমারচর, নিঝুমদ্বীপ, চর উসমানসহ বেশকিছু ডুবোচর এবং আগে রয়েছে চট্টগ্রাম জেলার সন্দীপ উপজেলা। সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই দ্বীপটিতে রয়েছে একাধিক পর্যটন কেন্দ্র। ভ্রমণের মৌসুমে এখানে ঘুরতে আসে দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ। পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেশ আলোচিত রয়েছে নিঝুমদ্বীপ। যা হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত একটি বিচ্ছিন্ন সর্বশেষ একটি ইউনিয়ন। যেখানে রয়েছে হরিণের সুবিশাল ঝাঁক, কেওড়া বনের সবুজ হাতছানি, দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত, দৃষ্টিনন্দন চরভূমি এবং নানাবিধ সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো দর্শনীয় স্থানগুলো। এরপর রয়েছে কমলার দীঘি, নিমতলী, তমরুদ্দি লঞ্চঘাট, সূর্যমুখী সমুদ্রসৈকত এবং লালচর সমুদ্রসৈকত। এ দ্বীপে সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো দর্শনীয় স্থানগুলোর কোনো অভাব নেই। অভাব রয়েছে মানুষের স্বপ্নপূরণের। এ দ্বীপের মানুষের ভোগান্তিরও কোনো শেষ নেই, যারা দর্শনার্থী আসেন তারাও হয়তো নানাবিধ ভোগান্তির মধ্যে পড়ে। তবে দ্বীপাঞ্চলের মানুষ অতিথিদের যথাযথ সম্মান করতে জানে, আত্মীয়তার বন্ধনে অতিথিপরায়ণতা করতে জানে। ভেতরে চাপা আক্ষেপ জমিয়ে রেখে মুখে হাসির পরশ এঁকে দিয়ে দূরের পথের মানুষের সঙ্গে হেসে বেড়ায় পরমানন্দে।  

হাতিয়াতে আগে বিদ্যুৎ ছিল না, গত বছর থেকে বিদ্যুতের কাজ চলছে। আগে প্রায় অন্ধকারের মধ্যে ডুবে থেকেছে গোটা একটি দ্বীপ। যা হাতিয়ার বাইরের অনেক মানুষ বিশ্বাসই করতে চাই না। পাকিস্তান সরকার হাতিয়ায় ৫টি ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে স্থাপন করেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। তবে এসব পুরোনো ইঞ্জিন দিয়ে বেশিদূর যাত্রা সফল হয়নি হাতিয়ার। অনেকটা বিকল হয়ে আসার পর মাত্র ৩টি ইঞ্জিন দিয়ে পৌরসভার মধ্যে সমাপ্ত ছিল বিদ্যুৎ ব্যবহার। বাকি ইউনিয়নগুলো সুবিধাবঞ্চিত ছিল। গত বছরের প্রথমদিকে হাতিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের আয়োজনে হাতিয়ায় সফর করে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সেখানে তিনি সাধারণ জনসাধারণকে প্রতিশ্রুতি দেন, হাতিয়া উপজেলাকে বিদ্যুতের আওতায় নিয়ে আসার। গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ বাস্তবায়নের প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয়? বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চুক্তি করা হয় দেশ এনার্জি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির সঙ্গে। কোম্পানিটি ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে চলমান থাকবে। বিদ্যুতের আলো দিয়ে হাতিয়া আলোকিত হলেও শিক্ষার আলো এখনও নিভু নিভু অবস্থার মধ্যে রয়েছে। অনেক ইউনিয়নের মধ্যে মানসম্মত শিক্ষা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তেমন কোনো সুব্যবস্থাও নেই। তবে বলা যায়, হাতিয়ায় সাক্ষরতার হার আগের তুলনায় অনেকটা এগিয়েছে। হাতিয়া উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নেমে এসেছে পরম দুর্ভোগ। অসচেতনতার নিখুঁত ছোঁয়ায় প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা তেমন বেশি শোভনীয় হচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীদের চাপ অনেকটাই কমে এসেছে। ভালো শিক্ষা অর্জনের জন্য শিশুদের ভিড় বাড়ছে কিন্ডারগার্টেন এবং নুরানি মাদ্রাসাগুলোর দিকে। এমনটা যে শুধু প্রাথমিক পর্যায়ের মধ্যে রয়েছে তা কিন্তু নয়, মাধ্যমিক পর্যায়ে রয়েছে আরও কত কী দুরবস্থা! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তার অবস্থানে অবস্থানরত থাকলেও শিক্ষকগুলো নিজেদের দায়িত্বে অবস্থারত নয়, মানি কর্মরত নয়? গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দোহাই পড়ে রাষ্ট্রের ওপর, সরকার ব্যবস্থাপনার ওপর, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। তবে খুব জমজমাটভাবে চলছে নিজস্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান প্রাইভেট নামক ব্যবসা-বাণিজ্য। দুর্ভোগে রাত কাটাতে হয় হাতিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা এবং মানুষের।  

সহজবাক্যে বলা যায়, হাতিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা শতকরা ৯০ ভাগ ভালো নেই। দু-একটা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত বাকি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে একই রীতি।  

স্বাস্থ্য সুরক্ষার মানদণ্ডে রয়েছে আরও দুর্ভোগ। নেই ভালো কোনো স্বাস্থ্যসেবা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও ভালো চিকিৎসা পেতে যেতে হয় দূরযাত্রায়। জনজীবনের দুর্ভোগের মধ্যে আরেকটি হলো হাতিয়ার স্বাস্থ্যসেবার নিম্নসেবা। রোগীদের দুর্ভোগের শেষ কোথায়? এর জবাব কারও কাছে নেই। 

যাতায়াত ব্যবস্থার কথা বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কত-শত কষ্টকর কঠিন দৃশ্যগুলো। পারাপারে ভোগান্তির যেন কোনো শেষ নেই। হাতিয়া থেকে নোয়াখালী যাওয়ার জন্য পাড়ি দিতে হয় বিশাল মেঘনানদীর বুক। এতে নেই কোনো ভালো ইস্টিমার। ট্রলারে নিত্য যাতায়াত করতে হয় সাধারণ জনসাধারণের। একটিমাত্র সি-ট্রাক থাকলেও, সেটা নিয়মিত যাতায়াত করতে অক্ষম। স্পিডবোট থাকলেও ভাড়া গুনতে হয় বেশি দামে, ৩০ মিনিটের পথের জন্য জনপ্রতি ভাড়া ৫০০ টাকা। কি আর করার, দিতে হয়- কিছুই করার নেই। সবাই একদিকে তালি বাজাচ্ছে, বিপরীতে তালি বাজানোর ক্ষমতা আছে কার? তালির সুর বাজতে না বাজতেই মাথা এসে পড়বে মাটির ধুলোতে। ক্ষমতার এই জোরকুস্তির খেলায় সাধারণ জনসাধারণের জীবন তেমনটা শোভনীয় নয়। দ্বীপাঞ্চল মানুষের জনজীবন দুর্ভোগের রাত পার করছে। অপেক্ষায় আশা বাঁধে আপনচিত্তে, যেন কেটে যায় সব ঘোর অন্ধকার। যাতায়াত ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সবখানে যেন ফিরে আসে সুব্যবস্থা। অপেক্ষায় আর কতদূর?

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত