ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মোবাইল গেমে আসক্তদের রুখবে কে?

আবু জাফর সিদ্দিকী, শিক্ষার্থী ও কলাম লেখক, [email protected]
মোবাইল গেমে আসক্তদের রুখবে কে?

মোবাইল গেমে আসক্ত দেশের ছাত্র-যুবসম্প্রদায়, তাদের রুখবে কে? মোবাইলের যেমন ভালো দিক রয়েছে, তেমনই খারাপ দিকও রয়েছে। গেম, অতিরিক্ত ইন্টারনেট ও ফেইসবুকে খারাপ দিকই বেশি। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সই মানুষ এখন মোবাইল ফোনে আসক্ত। বিশেষ করে পাবজি-ফ্রি ফায়ার গেমে আসক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও যুব সম্প্রদায়। করোনাভাইরাসে স্কুল-কলেজ ও কোচিং বন্ধ প্রায় ১ বছর ধরে। বাড়িতেও তারা পড়াশোনা তেমন করে না। তবে মোবাইলে ঠিকই আসক্ত তারা। পাবজি-ফ্রি ফায়ার, ফেইসবুক, ইন্টারনেট, ম্যাসেঞ্জার, টিকটকেই এখন তাদের ব্যস্ত সময় কাটে। বিভিন্ন দোকান, মোড়ে ও শহরের অলিগলিতে ব্রডব্যান্ড লাইন, ফ্রি ওয়াই-ফাই, বিভিন্ন ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছাত্র ও যুবসম্প্রদায়। অভিভাবক, এলাকার মুরুব্বি, শিক্ষক, বড় ভাই কারও কথায় তারা কর্ণপাত করে না। সেই সকাল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত চলে তাদের এ ব্যস্ততা। দুপুরে কোনোরকম গোসল করে, কেউ খেয়ে আবার কেউ না খেয়েই বসে পড়ে গেম আসরে। পড়াশোনা তো করছেই না, আবার অতিরিক্ত মোবাইল গেমে আসক্তি ধ্বংস করছে এ সমাজকে। এতে করে তারা পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ হচ্ছে, অর্থব্যয় হচ্ছে, অভিভাবকের অবাধ্য হচ্ছে। সর্বোপরি চোখ, মস্তিষ্ক ও শরীরের ক্ষতিসাধিত হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই অনলাইন গেম, মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর আগে ২০১৩ সালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত মানসিক রোগ নির্ণয়-বিষয়ক গাইডলাইনে (ডিএসএম-৫) বিষয়টিকে ‘ইন্টারনেট গেমিং ডিজঅর্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করে গবেষণার ভিত্তিতে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করার সুপারিশ করা হয়েছিল।

গেম আসক্তি বিষয়টি ইন্টারনেট আসক্তি থেকে খানিকটা আলাদা। কখনও দেখা যায়, ইন্টারনেটে কেউ অতিরিক্ত পরিমাণে গেম খেলছে, কেউ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, কেউবা নানা সফটওয়্যার বা এসব নিয়ে মশগুল, আর কেউবা ফেইসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করছে দিনের বেশিরভাগ সময়। মোটদাগে সবই হচ্ছে ননকেমিক্যাল অ্যাডিকশন বা আচরণজনিত আসক্তি। বিশ্বজুড়ে এ বিষয়ে প্রকাশিত ১৬টি গবেষণাপত্রের মেটা অ্যানালাইসিস করে দেখা গেছে, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ইন্টারনেট গেমিংয়ের আসক্তিতে ভুগছে, যাদের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হচ্ছে কিশোর আর ১ দশমিক ৩ শতাংশ কিশোরী (জে ওয়াই ফ্যাম, ২০১৮)।

বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসির তথ্যমতে, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে প্রায় ৯ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ ইন্টারনেটের গ্রাহক, আর তাদের মধ্যে আট কোটি ৭৯ লাখ ব্যবহারকারী মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়। ২০১৬ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৩৫ শতাংশ হচ্ছে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী, অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরী। এরাই কিন্তু গেমিংয়ে আসক্ত হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ইন্টারনেট বা গেম খেলা কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নয়। কিন্তু এর ক্ষতিকর, অযৌক্তিক ও অপরিমিত ব্যবহার চিন্তা আর আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে। এ ইন্টারনেটের ব্যবহার বা গেম খেলার বিষয়টি যখন তার চিন্তা আর আচরণের ওপর খারাপ ধরনের প্রভাব ফেলে, সামাজিক দক্ষতা কমিয়ে দেয়, বা দৈনন্দিন জীবনযাপনের মান খারাপ করে দেয়, তখন তা আসক্তির পর্যায়ে চলে যায়।

ইন্টারনেট ব্যবহার করলেই সেটাকে নেতিবাচকভাবে নেয়া যাবে না। দেখতে হবে সেটি আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে কি-না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য গবেষণা দলের মতে, গেমিং আসক্তির লক্ষণগুলো ১২ মাস ধরে থাকতে হবে। তবে লক্ষণ যদি গুরুতর ধরনের হয়, তবে সেগুলো অল্প দিন ধরে লক্ষণ দেখা দিলে সেটাকেও গেমিং ডিজঅর্ডার বলা যাবে। কিছু লক্ষণ, ইন্টারনেট ব্যবহার বা গেম খেলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। অর্থাৎ ঘনঘন খেলতে থাকবে, অনেক বেশি সময় ধরে ইন্টারনেট ব্যবহার করবে এবং এত নিবিষ্টভাবে সেটিতে মগ্ন থাকবে, যে চারপাশের অনেক কিছু তার মনোযোগ পাবে না।

ভিডিও গেম, প্লে-স্টেশন, স্মার্টফোন বা ট্যাবের স্ক্রিনে শিশুর ডুবে থাকার পুরো দায় অভিভাবকের। গবেষণা বলছে, শিশুরা ভিডিও গেমে কী খেলছে তার ওপর নির্ভর করে তার আচরণ। নিজেদের জীবনযাপন বাধামুক্ত রাখতে এবং সহজে শিশুকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডিভাইস ধরিয়ে এক জায়গায় বসিয়ে রাখেন অভিভাবকরা। ফলে শিশুর আশপাশের জগৎ বা প্রতিদিন যে নতুন বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। গবেষকরা বলছেন, অভিভাবকরা যদি তাদের সন্তানদের ভিডিও গেম খেলার মাত্রা এবং স্ক্রিনে কী দেখবে তার ধরনের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাহলে প্রভাবটি কমতে পারে। আর শিশুদের গড়ে তোলার পদ্ধতি নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, যেহেতু নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, তাই ভিডিও গেমের সঙ্গে পরিচিত না করানোই একমাত্র উপায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে যারা ভিডিও গেম খেলে তার দুই থেকে তিন শতাংশ ‘গেমিং ডিজঅর্ডারে’ ভোগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সে কারণে ভিডিও গেম আসক্তিকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার তালিকাভুক্ত করেছে।

শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকে যারা প্রতিনিয়ত সহিংসতামূলক ভিডিও গেম খেলে, তারা শিক্ষাবর্ষের শেষে গিয়ে উগ্র হয়ে যাচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে গবেষকরা জানতে পারেন, গেম খেলার পরিমাণ এবং গেমের ধরনের ওপর বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভরশীল। স্কুলের পারফরম্যান্স খারাপ হওয়ার পেছনে ভিডিও গেম খেলার পরিমাণ অনেকাংশে দায়ী। সহিংসতামূলক ভিডিও গেম খেলার মধ্য দিয়ে ‘পৃথিবীটা একটা নির্মম জায়গা’ এ রকম একটা ধারণার জন্ম নেয়। কথাবার্তা ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মধ্যে এক ধরনের উগ্রতা কাজ করে, সমাজগত আচরণ তাদের মধ্যে লোপ পায়। যদি অভিভাবকরা সন্তানদের ভিডিও গেম খেলার পরিমাণ এবং স্ক্রিনে কী দেখবে, তার ধরনের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে প্রভাবটি কমতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত