ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভারতের জন্য বাংলাদেশ কেন গুরুত্বপূর্ণ?

সামারা আশরাত, পিএইচডি ফেলো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, তিনি ‘ইউরেশিয়া রিভিউ’-এর জন্য দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে লিখেন
ভারতের জন্য বাংলাদেশ কেন গুরুত্বপূর্ণ?

সম্প্রতি, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন যে, ভারতের যদি একটি সীমান্ত এবং একটি অঞ্চল থাকে যা গত দশকে নাটকীয়ভাবে উন্নত হয়েছে, তা হলো পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারত। আর তার কারণ হচ্ছে- ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।

শুধু তাই নয়, সম্প্রতি ভারতও বাংলাদেশে একটি বিমানবন্দর নির্মাণ ও পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ভারত আগরতলা বিমানবন্দরকে আপগ্রেড ও সম্প্রসারণের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাংলাদেশের এক টুকরো জমি চায়, যা এই বছরের শেষের দিকে বা আগামী বছরের শুরুর দিকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তৃতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিণত হতে চলেছে। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পর, আগরতলা এবং ঢাকার মধ্যে ফ্লাইট এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য শহর যেমন চট্টগ্রাম ও সিলেট, পরিচালনা করা হবে।

শুধু এ দুই রাজ্যই নয়, সেভেন সিস্টারস ডেভেলপমেন্টের বাকি পাঁচটি রাজ্যও বাংলাদেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কারণেই ভারত বারবার তার অ্যাক্ট ফাস্ট ফর নর্থইস্ট নীতিতে বাংলাদেশের অবদানকে স্বীকার করেছে।

এর পেছনের মূল কারণ, বাংলাদেশ ভারতের জন্য তার অ্যাক্ট ফাস্ট ফর নর্থইস্ট নীতি বাস্তবায়নের জন্য তুরুপের তাস। আর চিকেনস নেক বা শিলিগুঁড়ি করিডোর ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব তৈরি করেছে। এ করিডোর ভারতের জন্য অন্যতম ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতা। এই সরু করিডোর সমগ্র উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করেছে। বাংলাদেশ ভারতের মূল ভূখণ্ড এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মধ্যে একটি বিস্তৃত সম্পর্ক তৈরি করে। কারণ আগরতলা-কলকাতা থেকে ১ হাজার ৬৫০ কিলোমিটার এবং নতুন দিল্লি থেকে শিলং এবং গুয়াহাটি হয়ে ২ হাজার ৬৩৭ কিলোমিটার। অন্যদিকে বাংলাদেশ হয়ে আগরতলা ও কলকাতার মধ্যে যাত্রা মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার।

উপরন্তু, বাংলাদেশের প্রধান শহর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে গড় দূরত্ব ২০ কিলোমিটার থেকে ৩০০ কিলোমিটার। ফলস্বরূপ, রেল, সড়ক ও নদীপথে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সংযোগের জন্য বাংলাদেশকে সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশ একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছে এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর উন্নয়নে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেই রাজ্যগুলোর মধ্যে ত্রিপুরা ও আসাম উল্লেখযোগ্য।

ত্রিপুরার জন্য বাংলাদেশ : ত্রিপুরা ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি আসিয়ান দেশগুলোতে ভারতের প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত হয়। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, বাংলাদেশ ভারত-অবরুদ্ধ হলে ত্রিপুরা বাংলাদেশ-অবরুদ্ধ। সুতরাং, বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার মধ্যে সম্পর্ক দীর্ঘ; এটি সভ্যতাগত, ঐতিহাসিক, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক। অনাদিকাল থেকে, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের জনগণ তাদের সমস্যা এবং সমৃদ্ধি ভাগ করে নিয়েছে। ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশ একটি ছিদ্রযুক্ত সীমান্ত ভাগ করে, যা ৮৫৬ কিলোমিটারের বেশি প্রসারিত, ত্রিপুরার সীমান্তের ৮৫ শতাংশ গঠন করে।

আগরতলা-আখাউড়া (বাংলাদেশ) রেলওয়ে সংযোগটি ২০২৩ সালের জুনে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যখন এটি সম্পূর্ণ হবে, এটি বাংলাদেশের গঙ্গাসাগরকে ভারতের নিশ্চিন্তপুর (১০.৬ কি.মি) সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং তারপর নিশ্চিন্তপুর থেকে আগরতলা রেলওয়ে স্টেশন (৫.৪৬ কি.মি) সংযোগ করবে। ভারতে আগরতলা-আখাউড়া রেললাইন চালু হলে বাণিজ্য সম্পর্কের সুযোগ খুলবে। শুধু তাই নয়, ভারত নিশ্চিন্তপুরে একটি সমন্বিত চেকপোস্ট এবং কার্গো-হ্যান্ডলিং সুবিধা তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে, যা ত্রিপুরার আগরতলা-আখাউড়া রেল সংযোগের সংযোগ স্থল। এ রেল সংযোগটি গুয়াহাটির পরিবর্তে ঢাকার মধ্য দিয়ে আগরতলা ও কলকাতার মধ্যে ভ্রমণের সময় কমিয়ে দেবে। আগরতলা এবং কলকাতার মধ্যে ভ্রমণের সময় বর্তমান ৩১ ঘণ্টা থেকে ১০ ঘণ্টা কমে যাবে, কারণ এটি ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের পরিবর্তে মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার অতিক্রম করবে।

ভারত ও বাংলাদেশের বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ এবং পশ্চিম বাংলাদেশের মধ্যে চারটি চালু রেল যোগাযোগ রয়েছে- পেট্রোপোল-বেনাপোল, গেদে-দর্শনা, রাধিকাপুর-বিরল এবং সিংহবাদ-রোহনপুর। শেষ দুটি নেপালি ট্রানজিট ট্রাফিক ব্যবহার সম্পর্কেও অবহিত করা হয়। বর্তমান লাইনটি শুধু আগরতলা থেকে নয়, মিজোরামের লোকদেরও সাহায্য করবে, যা ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

এই দুটি সংযোগ প্রকল্পের সমাপ্তির সঙ্গে সাব্রুম, ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ফেনী সেতু এবং আগরতলা-আখাউড়া রেললাইনের সঙ্গে সংযোগকারী ফেনী সেতু, ত্রিপুরা একটি ‘ভূমিবেষ্টিত’ থেকে একটি সুসংযুক্ত রাজ্য হিসাবে আবির্ভূত হবে। এইভাবে ত্রিপুরা ভারত, মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডকে সড়কপথের মাধ্যমে সংযুক্ত করে তার সংযোগ ও সম্পর্ক গড়ে তুলবে।

ত্রিপুরার মহারাজা বীর বিক্রম বিমানবন্দরটি এ বছরের মধ্যে নতুন টার্মিনাল সম্পূর্ণ হওয়ার পরে ল্যান্ডলকড উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের তৃতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হবে। এ বিমানবন্দরের কাজ শেষ হলে আগরতলা ও ঢাকার মধ্যে ফ্লাইট চলাচলের পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো অন্যান্য শহরও চলাচল করবে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধার্থে বাংলাদেশে নতুন বিমানবন্দরে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছেন। এয়ার কানেক্টিভিটি শুধু বাংলাদেশ, ভারতের মূল ভূখণ্ড এবং ত্রিপুরার মধ্যেই নয়, ভারত ও আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যেও যোগাযোগ জোরদার করবে।

আসামের জন্য বাংলাদেশ : আসামের জন্য বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূকৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত। ভুটান এবং মিয়ানমারের সঙ্গে আসামের চারপাশে বাংলাদেশ একটি মূল ত্রিভুজ গঠন করে। কৌশলগত অবস্থানের কারণে, বাংলাদেশ এবং আসামের মধ্যে ব্যবসা, পরিবহণ, বাণিজ্য এবং সংযোগের জন্য বেশ কিছু সুযোগ রয়েছে।

তাছাড়া বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের সেতু। বাংলাদেশ অ্যাক্ট ইস্ট নীতির একটি প্রাকৃতিক স্তম্ভ। এটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং তার বাইরের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংযোগের জন্য একটি ‘সেতু’ হিসেবে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরামের (যেমন- বিবিআইএন, বিমসটেক) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আসামের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর এবং পরবর্তীকালে আসিয়ান দেশগুলোতে প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের অনেক সম্ভাব্য উপায় রয়েছে কারণ ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপনে অগ্রগতি করেছে। বর্তমানে, বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মোংলাবন্দর ব্যবহার করে ভারতের বিভিন্ন অংশের মধ্যে পণ্য স্থানান্তর করার জন্য ভারতকে অনুমতি দেয়, যা শিপিংয়ের খরচ এবং গতি কমিয়ে দেয়। শুধু এ দুই রাজ্যই নয়, সেভেন সিস্টারস ডেভেলপমেন্টের বাকি পাঁচটি রাজ্যও বাংলাদেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কারণেই ভারত বারবার তার অ্যাক্ট ফাস্ট ফর নর্থ ইস্ট নীতিতে বাংলাদেশের অবদানকে স্বীকার করেছে।

থাইল্যান্ডের প্রভাবশালী ‘ব্যাংকক পোস্ট’ থেকে অনুবাদ : মেহজাবিন বানু

সূত্র : https://www.bangkokpost.com/opinion/opinion/2483380/bangladeshkey-to-indias-northeast

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত