ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের মেরামত

কাজী রশীদুল হক পাশা
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের মেরামত

বাংলাদেশে নাকি কোনো গণতন্ত্র নেই। বিরোধী দল এই কথা দিনের পর দিন বলে বেড়াচ্ছে এবং তারা এই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্যই আন্দোলন করছে। এমন অবস্থা যে, তাদের সময় গণতন্ত্র ছিল- এখন তা নেই। সেই গণতন্ত্র আবার উদ্ধার করতেই তাদের এই আন্দোলন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই- এটি একটি রাজনৈতিক অসাধুতা। মিথ্যাচার। বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। এমন গণতন্ত্র বিশ্বের অনেক দেশেই নেই। যারা আজ গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে মাঠে নেমেছেন, তারাই কিন্তু এদেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। গণতান্ত্রিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগই গণতন্ত্র আবার ফিরিয়ে আনে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। জোর দিয়েই বলা যায়, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কোনো কমতি নেই। গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্র নেই ও বুলি যারা সবসময় আওড়ান তাদের সততা সম্পর্কে সন্দেহ থাকাই স্বাভাবিক। সংবাদপত্রে, সভাসমিতিতে, টকশোতে- সবখানেই বিরোধীরা বলছেন গণতন্ত্র নেই।

গণতন্ত্র নেই। কেন নেই, কীভাবে নেই- এ কথা কেউ বলছে না। ফলে গণতন্ত্র যে নেই এ কথা কেউ বিশ্বাসও করছে না। বিশ্বাস করলে সাধারণ মানুষ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পথে নামত। বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, এটা কেউ প্রমাণ করতে পারছে না। দেশে গণতন্ত্র আছে বলেই গণতন্ত্র নেই- এ কথা বলা যাচ্ছে। গণতন্ত্র আছে বলেই আন্দোলন হচ্ছে। গণতন্ত্র আছে বলেই ভোট হচ্ছে। গণতন্ত্রই আছে বলেই মানুষ ভোট দিতে পারছে। দেশে যা কিছু হচ্ছে, যে যা কিছু বলছে- সবই গণতন্ত্রের জন্যই হচ্ছে। গণতন্ত্র আছে বলেই হচ্ছে। সম্প্রতি বেশ কিছু নির্বাচন হয়ে গেল। ভোটাররা ভোটও দিল। জয়-পরাজয়ও হলো। তাহলে গণতন্ত্র নেই কেন? কেন গণতন্ত্রকে উদ্ধার করতে হবে। যে গণতন্ত্র উদ্ধারের কথা বলা হচ্ছে, সেটা কি গণতন্ত্র বা কেমন গণতন্ত্র, তা তো বিরোধীরা বলছেন না। তার চেহারা কেমন, চরিত্র কেমন, এতে জনগণের লাভই বা কী হবে- সবকিছু ব্যাখ্যা করে বলতে হবে। কোন গণতন্ত্র চান তারা। এটা কোথা থেকে আসবে। তৈরি হবে। কারাই বা তৈরি করবে। নতুন কোনো ফর্মুলা আছে নাকি। এমন অনেক প্রশ্নই উঠছে বিরোধী দলের গণতন্ত্র নিয়ে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার রক্ষা করা হয় না, গুমণ্ডখুন ইত্যাদি নানা অভিযোগ নিয়ে বিদেশিদের কাছে দিনের পর দিন ধরনা দেয়ায় বিরোধীদের আচরণে ক্ষুব্ধ জনগণ। কারণ এমন অভিযোগের কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি তারা। বাংলাদেশ যে একটি গণতান্ত্রিক দেশ- এ কথা জাতিসংঘসহ সারা বিশ্বই বিশ্বাস করে। সুতরাং দেশে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলন চলছে- এটা অচল ধারণা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণতন্ত্র এখন আর এক জায়গাতে থেমে নেই। গণতন্ত্র দেশে দেশে ভিন্ন রূপে অবস্থান করছে। সবই গণতন্ত্র, তবে একেক দেশে তার রূপ একেক রকম। অর্থাৎ সেই দেশের জনগণের চাহিদা ও মতামতের ওপর ভিত্তি করেই গণতন্ত্র প্রবাহিত। এক দেশের গণতন্ত্র দেখে অন্য দেশ নাখোশ হতে পারে। যেমন পশ্চিমা দেশগুলো এশিয়ান গণতন্ত্র দেখে তা সঠিক বলে মনে নাও করতে পারে, তবে দেশ ও জনগণ অনুযায়ী গণতন্ত্র যে সঠিক তা পরে জানতে বাধ্য হয়। যেমনি আমেরিকার গণতন্ত্র, ইউরোপের গণতন্ত্র, এশিয়ার গণতন্ত্র, আফ্রিকার গণতন্ত্র- সবগুলোই তো একরকম নয়। তেমনি বাংলাদেশের গণতন্ত্র যে একই রকম হবে, তার কোনো মানে নেই। এটা হয়ও না। বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে তো নয়ই। আর সব দেশে একই রকমের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র গ্রহণ করে ভিন্ন দেশে ভিন্ন আঙ্গিকে তার প্রতিফলন হবে। এটাই বাস্তব। এটা এখন মেনে নিতে হবে। গণতন্ত্র অর্থাৎ জনগণের তন্ত্র। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। বলা যায়, সেই দেশের অধিকাংশ জনগণের মতামতকে গ্রহণ করে দেশ পরিচালিত হবে। আমাদের দেশে কি তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেছে? যদি না ঘটে থাকে, তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রকে উদ্ধার করতে হবে- এ কথার মানে কী? এ কথার মানে কেউ জানে না। যারা বলছে তারা মিথ্যা বলছে। তারা যে মিথ্যা বলছে সেটাও গণতন্ত্রের জন্য বলতে পারছে। গণতন্ত্র না থাকলে বলতে পারত না। কেউ বলবেন আমরা আমেরিকার মতো গণতন্ত্র চাই, কেউ বলবেন ইংল্যান্ডের মতো গণতন্ত্র চাই। কেউ বলবেন ভারতের মতো গণতন্ত্র চাই, কেউ বলবেন ইন্দোনেশিয়ার মতো বা থাইল্যান্ডের গণতন্ত্র হবে বাংলাদেশের মতো। বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে চায়, যেভাবে পছন্দ করে, সেভাবেই এখানে গণতন্ত্র চালু থাকবে। আমাদের দেশের গণতন্ত্র আমাদের মতোই। আমরা রক্ত দিয়ে দেশ এনেছি, অনেক ত্যাগ ও সংগ্রাম করে দেশে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা করেছি। আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্যই ছিল গণতন্ত্র। পাকিস্তান আমলে আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন এ জন্য সংগ্রাম করেছেন। জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। তার পরেই দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। স্বাধীন দেশের সেই গণতন্ত্র ধ্বংস করেছিল স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা কৌশলে ক্ষমতায় এসে। পরে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা আবার ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। পরাজিত শত্রুরা সেই গণতন্ত্রকে আবার ধ্বংস করার জন্য গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে তৎপর হয়েছে। জনগণকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। গণতন্ত্র নিয়ে এদেশে অনেক খেলা হয়েছে। গণতন্ত্র নিয়ে অতীতে অনেক টালবাহানা করা হয়েছে। গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালে নির্বাচনের পর এদেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, একে আর ধ্বংস করতে দেয়া হবে না কাউকে।

আমরা তেমন গণতন্ত্র চাই না, যে গণতন্ত্রে মানসিক ভারসাম্যহীন কোনো ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হতে পারে। আমরা তেমন গণতন্ত্র চাই না, যেখানে যাকে ইচ্ছা তাকে গুলি করে মারা হয়। আমরা তেমন গণতন্ত্র চাই না, যে গণতন্ত্রে শিশু জন্ম নেয়ার পর গুলির শব্দ শোনে। আমরা তেমন গণতন্ত্র চাই না, যেখানে ধর্মের নামে মানুষ পিটিয়ে মারা হয়। আমরা তেমন গণতন্ত্র চাই না, যেখানে এক সম্প্রদায়ের ওপর আরেক সম্প্রদায় চড়াও হয়। আমরা চাই সেই গণতন্ত্র, যে গণতন্ত্র সবাইকে একত্রিত করে দেশপ্রেমে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। দেশদ্রোহীদের পেছনে ফেলে এগোবে। নির্বাচনে ভালো মানুষ বাছাই করে ক্ষমতায় বসাবে। যে গণতন্ত্র হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে একে অপরের ভালোবাসায় শিক্ত হবে। আমি মনে করি, আমাদের দেশে এমন গণতন্ত্রই দরকার, যা আমাদের একান্তই নিজস্ব। এই গণতন্ত্রই আমরা প্রতিষ্ঠিত করেছি। ভবিষ্যতে একে আরও সুদৃঢ় করব। সুতরাং বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, এ কথা কেউ বলবেন না। যারা বলবেন, তারা দেশকে ভালোবাসেন না। তারা দেশকে আবার কোনো অগণতান্ত্রিক বেড়াজালে আটক করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করবেন। আমাদের সবাইকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।

গণতন্ত্রের সঙ্গে আরেকটি কথা বিরোধীরা জোরের সঙ্গেই বলছেন তা হলো, রাষ্ট্রের মেরামত। এটাও ওই পরাজিত শক্তির কথা। তারা বলছে, রাষ্ট্র ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে, তারা তার মেরামত করার জন্য ২৭ দফা প্রস্তাব দিয়েছে। কার রাষ্ট্র কে মেরামত করে? রাষ্ট্রটা বিজয়ীদের। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী। পরাজিত শত্রুদের নয়। পরাজিত শত্রুরা দেশটাকে ভেঙেচুরে বিনষ্ট করে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসে বিগত ১৪ বছরে দেশটার মেরামত কাজ শেষ করেছে। দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। মেরামত করার কিছুই নেই। বলা যায়, এখন সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলছে। মেরামতের প্রয়োজন নেই। নষ্ট করেছিল পরাজিত শত্রুরা, বিজয়ীরা তা মেরামত করে ফেলেছে। এখন আর কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই, যেখানে হাত দিতে হবে। সুতারাং রাষ্ট্রের মেরামত কাজ করা একটা ধাপ্পাবাজি। দেশে গণতন্ত্র নেই যেমন এক রাজনৈতিক অসাধুতা, তেমনি রাষ্ট্রের মেরামত করাও বিরোধী দলের এক ধাপ্পাবাজি। রাজনীতিতে এত অসাধুতা আজ অচল। বিরোধী দলকে এই পথ পরিহার করে স্বাভাবিক পথে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এগোতে হবে। নইলে দিনে দিনে এইসব দলের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। বিএনপি মনে করে, তারাই এখন দেশের সবচেয়ে বড় দল। এ কথা প্রমাণ করতে যা করা দরকার, তা তারা করছে না। মুখে বলেই কাজ শেষ করতে চাচ্ছে। কিন্তু আজকাল মুখের কথা কে বিশ্বাস করে? কেউ করে না- এ কথাটা বিএনপি বুঝতে পারছে না অথবা বুঝতে পেরেও তা স্বীকার করতে চাচ্ছে না। প্রায় বছর ঘুরে আসতে চলল বিএনপি নানা ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করার চেষ্টা করছে। এখনও তা জমাট বাঁধল না। আর কবে বাঁধবে তাও জানে না। এর কারণ, তারা যে ইস্যুগুলো দাঁড় করিয়েছে, তা জনগণ পছন্দ করেনি বা ইস্যুগুলো সাধারণ মানুষের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তাও তারা ভাবতে পারেনি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বিএনপি যদি নানা বিভ্রান্তিকর ইস্যু সামনে না এনে শুধু ভোট পাওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করত, তাহলে সুফল পাওয়া যেত। এখন কী হবে? সরকারকে ঠেলে ফেলে নিজেরা সরকার গঠন করে তার আওতায় নির্বাচন করাতে পারবে বলে কি মনে হয়? কোনোভাবেই তা সম্ভব হবে না। তাহলে কী হবে। সরকারকে ফেলতেও পারবে না আবার নির্বাচনেও অংশ নেবে না- পরিণতি কী হবে তা বোঝাই যাচ্ছে।

এ কথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, এবারের জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। বিএনপি তা মানুক বা না মানুক, সময় বলে দেবে নির্বাচন কেমন হবে। যে কথা বলে তারা এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাচ্ছে না, তা ভুল প্রমাণিত হলে তারা কী করবে তা পরিষ্কার নয়। হয়তো অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে, সেটাও ব্যর্থ হবে। তাদের ব্যর্থতার ইতিহাস তো কম নয়। ব্যর্থতার সংখ্যায় আরও নতুন কিছু যুক্ত হবে। তাহলে আমরা উপসংহারে একথা বলতে পারি যে, বাংলাদেশ আবধ গণতন্ত্র বিরাজমান। গণতন্ত্রে কোনো রকম ঘাটতি নেই। গণতন্ত্রের জাহাজ ভাসমান এবং চলমান। তাই ডোবার কোনো প্রশ্নই নেই, তাই উদ্ধারেরও দরকার নেই। আর রাষ্ট্রের মেরামত? মেরামতেরও দারকার নেই। বিরোধীরা দীর্ঘদিন ধরে দেশে যেসব ক্ষতচিহ্ন তৈরি করেছিল গত ১৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগ তা সব মেরামত করে মুছে দিয়েছে। এখন কোনো ক্ষত আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুতরাং মেরামতেরও কোনো দরকার নেই।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত