দেশের উন্নয়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিসর বাড়ার পাশাপাশি ব্যাংক ব্যবস্থার বিস্তার যেমন ঘটেছে, তেমনি বেড়েছে গ্রাহকসেবার পরিসর। আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার ধারণা অন্তর্ভুক্ত করে দেশের সব ব্যাংকই ডিজিটাল করা হচ্ছে। তবে লক্ষণীয়, পরিবর্তনশীল চাহিদা পূরণে ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে অনলাইন ও ডিজিটালের দিকে ঝুঁকলেও ঠিকভাবে নেয়া হয়নি নিরাপত্তাব্যবস্থা। বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত ডিজিটাল কারসাজির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট। ব্যাংকের এটিএম বুথগুলোতে দেশি-বিদেশি হ্যাকারদের আক্রমণের কথাও অজানা নয়। বলা হচ্ছে, ভঙ্গুর সাইবার নিরাপত্তা, অদক্ষ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আর দুর্বল তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামোয় সাইবার হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে ডিজিটাল ব্যাংকিং সিস্টেম। এ নিয়ে বেশ আগেই দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে লিখিত ও মৌখিকভাবে সতর্ক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। কিন্তু সেই সতর্কবার্তা খুব কাজে এসেছে তা বলা যাবে না। এবার সরকারের উচ্চ মহল থেকে দেশের সাইবার নিরাপত্তা জোরদারের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সূত্রমতে, ১২ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় এ নির্দেশ দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় মন্ত্রিসভার বৈঠক। ব্যাংকিং খাতের আস্থা ধরে রাখতে অবশ্যই সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা সময়ের দাবি।
লক্ষণীয়, দেশের প্রতিটি ব্যাংক ডিজিটাইজড করা হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংক ইলেকট্রনিক্যালি কানেক্টেড এবং আর্থিক লেনদেনের অধিকাংশ কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালিত হয়। অর্থাৎ টাকা ভার্চুয়াল হয়ে গেছে, যার সবই থাকে ব্যাংকে। তাই ব্যাংকগুলো যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে ব্যাংকের ওপরে নির্ভর করে আর্থিক লেনদেনের যত চ্যানেল আছে, যেমন : মোবাইল ব্যাংকিং, এটিএম কার্ড পেমেন্ট সবই ঝুঁকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) বলেছে, আধুনিক ব্যাংকব্যবস্থা শুরুর পর গত ২ বছরে দেশের ৬৮ শতাংশ ব্যাংক ম্যালওয়্যার আক্রমণের শিকার হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর একটি বড় অংশ র্যানসমওয়্যার আক্রমণের মুখে পড়েছে। এ ধরনের আক্রমণে ব্যাংকের তথ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। স্মর্তব্য, কিছুদিন আগে ব্যাংক, মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারের মধ্যে অর্থ স্থানান্তরে ‘বিনিময়’ নামে একটি সেবা চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উদ্বোধনের ৭ দিনের মধ্যেই প্রতারণামূলকভাবে এ প্ল্যাটফর্ম থেকে ৯৭ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এ থেকে সাইবার নিরাপত্তার গুরুত্বটি উপলব্ধি করা যায়। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে সাইবার হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট ১০ কোটি ১০ লাখ ডলারের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটেছিল, যাকে ব্যাংকিং খাতে পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় চুরির ঘটনা বলা হয়। এরপর থেকেই সাইবার হামলার বিষয়টি দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়। এই উদ্বেগ নিরসনে যথাযথ পদক্ষেপ নিতেই হবে।
ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নের স্বার্থেই ভালো রকমের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিআইবিএম প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদেন বলা হয়, নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারে বিনিয়োগ ঘাটতি, দক্ষ কর্মী এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও গ্রাহকদের সচেতনতার অভাবে দেশের ৩৬ শতাংশের বেশি সংখ্যক ব্যাংক সাইবার হামলার উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। ঝুঁকি মোকাবিলায় চিহ্নিত সমস্যাগুলোর সমাধান জরুরি। প্রতিবেদনে তথ্যপ্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধান ও উপকরণ বিক্রেতাদের বেশিরভাগ অপরাধের ক্ষেত্রে নেপথ্যে থাকার জন্য দায়ী করা হয়। অর্থাৎ যেসব ব্যক্তি ও সংস্থা বিভিন্ন ব্যাংকে সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার সরবরাহ এবং স্থাপন করে, তারাই অনেক ক্ষেত্রে সাইবার অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এ ধরনের অপরাধীদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।