ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। কিন্তু বর্তমানে শীতকালেও ডেঙ্গুর আভাস পাওয়া যায় এবং বেশ কয়েকজন রোগী শনাক্ত হয়। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে সচরাচর এ জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলোর মাঝে রয়েছে তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, চোখ, পিঠ, পেশিতে ও গিঁটে ব্যথা, গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি এবং খাবারে অনিহা সৃষ্টি হওয়া। ডেঙ্গু সাধারণত দুই ধরন হয়ে থাকে। ক্ল্যাসিকাল ও হেমোরেজিক।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুতে জ্বর সাধারণত দুই থেকে ৭ দিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যায়। অপরদিকে হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে ৫ থেকে ৭ দিন পর সংকটাপন্ন অবস্থা দেখা দেয়। অনেক সময় নাক, মুখ, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তপাত, এমনকি মলের সঙ্গেও রক্তপাত হতে পারে। মনে রাখতে হবে, এডিস মশা অভিজাত এলাকায় বড় বড় দালান কোঠায় বাস করে। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই মশা ডিম পাড়ে।
ময়লাযুক্ত দুর্গন্ধ ড্রেনের পানি এদের বসবাস নয়। জমানো প্রাণীর খাবার পাত্র, পানির পাত্র, ফুল গাছের টব, নারকেলের মালা, ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার, খোলা একুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনার ইত্যাদিতে জমা পানি থেকে প্রাদুর্ভাব ঘটে।
বাংলাদেশে স্বাভাবিকভাবে বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়। তবে আজকাল সারা বছরজুড়েই ডেঙ্গুর প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে অঞ্চলভেদে থেমে থেমে গ্রাম থেকে শহরে অনেক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। ২০২১ সালে সারাদেশে প্রায় সাড়ে ২৮ হাজার মানুষ আক্রান্ত এবং ১০৫ জন ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করেন।
তবে পরবর্তী বছর ২০২২ সালের মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা কপালে ভাঁজ পড়ার মতো। আক্রান্তের সংখ্যা আড়াই গুণ বেড়ে ৬১ হাজার ৭৫৫ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকার বাসিন্দা ছিল প্রায় ৩৯ হাজার। আক্রান্তের সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে কক্সবাজার, বরিশাল, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, খুলনাসহ অন্যান্য বিভাগেও কমবেশি এ ভাইরাসের মুখামুখি হয়েছে। অপরদিকে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ২০২১ সাল থেকে প্রায় তিনগুণ। এই সমস্যার একমাত্র উত্তরণের উপায় হচ্ছে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
শহরে পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক মশা নিধন অভিযান করলেও তা হচ্ছে অপ্রতুল। অপরদিকে গ্রামে স্থানীয় সরকারের তো এ বিষয়ে নেই কোনো ভ্রুক্ষেপ। ফলে গ্রামীণ মানুষ কীভাবে নিজেরা একটু সচেতন হলে মৃত্যুঝুঁকি থেকে বাঁচা যায়, সে সম্পর্কে অবগত নয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ ও জনবলের ঘাটতি রয়েছে। ফলে নিয়মিত কীটনাশক ও ক্যাম্পেইন করা সম্ভব হয়নি। তাই ব্যক্তিগত সচেতনতা ও প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।
কেননা, ডেঙ্গু মশার সৃষ্টি আমাদের কর্মফল। যদি আমরা নিজের বাসস্থান, আসবাবপত্র ও চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না রাখি, তাহলে সামান্য কীটনাশক ব্যবহার করে মশা নিধন অসম্ভব। তাছাড়া, সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি ও সামাজিক অঙ্গ-সংগঠনগুলোকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।
তারা বিভিন্ন সময় ক্যাম্পেইন, হ্যান্ডবিল বিতরণ ও বাসায় গিয়ে ডেঙ্গুর উৎপত্তি ও প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে পারে। এক্ষেত্রে যুবসমাজ ও শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অপরিসীম।
ডেঙ্গু যেহেতু সন্ধ্যা ও সকাল বেলায় কামড় দেয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সঠিকভাবে মশারি টানাতে হবে এবং বিশেষভাবে শিশু ও বৃদ্ধের প্রতি পরিবারের সচেতন ব্যক্তি নজর রাখতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বরে রোগীর শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলেও অ্যাসপিরিনজাতীয় ওষুধ দেয়া যাবে না। ডেঙ্গু জ্বরের মূল চিকিৎসা হলো শরীরে পর্যাপ্ত পানি পান করা। পানির পাশাপাশি ফলের রস, ওরস্যালাইন, ডাবের পানি, শরবত প্রভৃতি তরল খাবার খাওয়াতে হবে। জ্বরের চার বা ৫ দিন পর সিবিসি ও প্ল্যাটিলেট বা অণুচক্রিকা পরীক্ষা করে নিতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। কিন্তু কোনো ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট ও কিডনি সংক্রান্ত সমস্যা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। প্ল্যাটিলেট কাউন্ট লাখের কম হলে ডেঙ্গুর কথা মাথায় রেখে পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর হয়তো বা নির্মূল করা যাবে না।
ডেঙ্গু সমস্যা আমাদের দেশে আগেও ছিল, এখনও আছে, মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। ডেঙ্গু জ্বর ভবিষ্যতেও থাকতে পারে। তাই সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আসুন আমরা এ স্লোগানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই- গণসচেতনতা বৃদ্ধি করি, ডেঙ্গুমুক্ত জীবন ও দেশ গড়ি।
* শিক্ষার্থী
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়