ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কালের কড়চা

সব কিছুর মূলেই টাকা

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, [email protected]
সব কিছুর মূলেই টাকা

শিরোনাম দেখে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন জাগবে, সব কিছুর মূল কী করে টাকা হতে পারে? হ্যাঁ সব কিছুর মূল যে টাকা তা আমি প্রমাণের চেষ্টা করব। এটা আপেক্ষিক সত্য নয়, একেবারে উচ্চতর সত্য কথা। দেখুন পৃথিবীটা দ্রুত বদলে যাচ্ছে; অত্যাধুনিক বিজ্ঞান সভ্যতার যুগে সবকিছুই বদলে যাচ্ছে। স্বাভাবিক কিংবা গতানুগতিক পুথিগত বিদ্যা অর্জন করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। চাকরির বাজারে সাধারণ শিক্ষার কোনো মূল্য নেই। কারণ, এখন শুরু হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ বা আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স (এ আই)। আমরা জানি পৃথিবীতে পর্বতপ্রমাণ সম্পদের কয়েকজন মালিকের মধ্যে অন্যতম একজন বিল গেট্স। তিনি মাইক্রো সফটের প্রতিষ্ঠাতা। এ মাইক্রোসফট এর মাধ্যমে বিল গেট্স প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। শ্রেষ্ঠ ধনীর তালিকায় নাম লিখাতে সক্ষম হয়েছেন। সম্মান মর্যাদা অর্জন করেছেন সম্পদের মাফকাঠিতে। এ ধন কুবের কিছুদিন আগে তরুণদের কিছু পরামর্শ দিয়েছেন, টুইট বার্তার মাধ্যমে। টুইটে তিনি বলেছেন, ‘আমি যদি পুনরায় কলেজ জীবনে ফিরে যেতাম, তাহলে আমার পড়াশোনার বিষয় হিসেবে বেছে নিতাম আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স (এ আই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিদ্যুৎ ও বায়োসায়েন্স।’ বিল গেট্স মনে করেন- আগামী বিশ্ব শাসন করবে এই তিন বিষয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অ্যানার্জি বা বিদ্যুৎ ও বায়োসায়েন্স এ তিনটি বিষয় বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হবে। এর মাধ্যমেই সম্পদ অর্জিত হবে বিপুল পরিমাণে। প্রযুক্তি ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী দুই দশকের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে যে, প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের জন্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাবহার প্রাধান্য পাবে। এমন কি কারখানা, নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, খুচরা বিক্রির দোকানগুলোতেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হবে। নবায়ণযোগ্য শক্তি যেমন- সৌর ও বায়ুশক্তির ব্যবহার বেড়ে যাবে। এই শক্তি ব্যবহারের ওপর নির্ভর করবে প্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধি।

আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, ধনতান্ত্রিক বিশ্ব যেমন পৃথিবী শাসন করে চলেছে, তেমনি কোন রাষ্ট্রে ধনী ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের শাসন যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে একই সঙ্গে রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার ওপর অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। সভ্যতা যত এগিয়ে যাবে অর্থবিত্ত ততটাই প্রভাব খাটাতে সুযোগ পাবে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে যেসব দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে রয়েছে এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে ধনী হয়েছে তাদের দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলেও সে বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু তারা তাদের চাইতে অনগ্রসর দেশগুলোর মানবাধিকার, গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। একইভাবে কোনো রাষ্ট্রের ব্যক্তিগত ধনবানরা অন্যায় অপরাধ করলেও টাকার জোরে তা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক- এখানে টাকাওয়ালা, প্রচুর ধন-সম্পদের মালিকরাই সর্বেসর্বা। দেশের আইনকানুন বিচারব্যবস্থায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। সভ্যতাকেও নেতৃত্ব দিচ্ছে ধনবানরা। যদিও বলা হয়ে থাকে আইন সবার জন্য সমান। কিন্তু প্রায়োগিক প্রক্রিয়ায় টাকার প্রভাবে সমতা রক্ষিত হচ্ছে না। তা যদি হতো তবে ৫ হাজার টাকা ঋণগ্রস্ত কৃষকের জেলে যেতে হতো না। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণগ্রহিতা সিআইপির মর্যাদায় অভিসিক্ত হন আর গ্রামের খেটে খাওয়া একজন কৃষক মাত্র ৫ হাজার টাকা ঋণগ্রহণ করে শোধ না করতে পেরে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়ান। আমাদের মহামান্য আদালত বিচারের রায় দেন কাগজপত্র দলিল দস্তাবেজের পর্যালোচনা সাপেক্ষে। কারণ এটাই নিয়ম। অপরাধ প্রমাণের জন্যে কাগজপত্র চাই, সাক্ষী চাই। যার বিস্তর টাকা আছে, সে বিচার নিজের অনুকূলে নেবার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সাক্ষী জোগাড় করতে পারেন, সে সঙ্গে ভালো দক্ষ আইনজীবীও নিয়োগ করে থাকেন। দরিদ্র প্রতিপক্ষ বিচারকার্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সাক্ষী জোগাড়ে ব্যর্থ হয়ে হেরে যান। অথচ ন্যায় পাওয়ার যোগ্যতা দরিদ্র লোকটিরই ছিল। বেচারা বিচারক, বিবেকের কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হন। আমরা প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখি বিনা অপরাধে দিনের পর দিন জেল খাটছে। প্রকৃত আসামির পরিবর্তে নামের মিল থাকায় নিরপরাধ ব্যক্তিকে জেলে যেতে হচ্ছে। আবার কোর্টে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও জেল থেকে বেড় হতে পারে না যথা সময়ে। আইনি নানা মারপ্যাঁচ ও জটিলতায় তাদের সাজা ভোগ করতে হয়। যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনৈক জেলের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অপরাধে জেলে নেয়া হয়, অথচ ওই ব্যক্তি টাচ্ মোবাইল ব্যবহার করেননি এবং কোনো ফেইসবুক চালাতেও জানেন না। তার নামে অন্য কেউ ধর্মীয় বিষয়ে পোষ্ট দিয়েছিল। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনও চালানো হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে যখন প্রমাণিত হয় ওই হিন্দু জেলে ব্যক্তি এটা করেননি, তারপরও তাকে অনেকদিন জেল খাটতে হয়েছিল। কারণ তার পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। এরকম ঘটনার উদাহরণ আরও রয়েছে। আমাদের বিচারব্যবস্থার সীমাহীন ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ নেই। চিহ্নিত, দাগি অপরাধীরা বীর দর্পে ঘুরে বেড়ায় সামাজিকভাবে চিহ্নিত অপরাধী টাকার জোড়ে মহান ব্যক্তির মর্যাদায় অভিসিক্ত। টাকা দিয়ে জনমত তার পক্ষে নিতে সক্ষম বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীও এ সব অপরাধীদের সমীহ করে চলেন।

ধর্ম আচারেও টাকার আধিক্য লক্ষণীয়। ধর্মের আধ্যাত্মিকতা টাকার কাছে পরাজিত। সমাজে একটা গুরুজি প্রথা চালু আছে। গুরু বা পীর সাহেবরা টাকার অংকে শিষ্যের মূল্যায়ন করেন। হিন্দু কোনো গুরুর কাছে দরিদ্র শিষ্যের গুরুত্ত্ব নেই। টাকাওয়ালা ধনী ব্যক্তিকে শিষ্য করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ ধনী শিষ্য যতটা দান দক্ষিণা দেবেন দরিদ্র শিষ্যটি তা দিতে পারবেন না। পীর সাহেবরা ধনী মুরিদের প্রতি বেশি আসক্ত হন। আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বরের কাছে ভক্তরা ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় প্রার্থনা করে থাকেন। ঐশ্বরিক জ্ঞান লাভের জন্য নয়। হিন্দুরা পূজার্চনা করেন অর্থ-প্রতিপত্তি লাভের প্রত্যাশায়, ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দই মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে। তেমনি অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও একই উদ্দেশে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানান। টাকার শক্তির কাছে ঈশ্বর শক্তি যেন গৌণ হয়ে উঠছে। বিত্তবান ব্যবসায়ীরা অনৈতিকভাবে টাকা রোজগার করে ধর্ম পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে- ফলে মানুষের কাছে এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, টাকাই ঈশ্বর, টাকাই সৃষ্টিকর্তা। টাকার মহিমায় মহিমান্বিত এ জগৎ। এ জগতে যার যত টাকা, অর্থবিত্ত-বৈভব আছে, সে ততবেশি শক্তিধর। এই শক্তির পেছনে আমরা ছুটে বেড়াচ্ছি। এই যে, দেশে দেশে যুদ্ধ সংগঠিত হচ্ছে এ যুদ্ধ কিসের জন্য? যুদ্ধে জয়লাভের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে! কেন এত অর্থ ব্যয়? এ অর্থ যুদ্ধবাজরা বিনিয়োগ হিসেবে ব্যয় করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র গোলাবারুদ ব্যবহার করা হচ্ছে- এ সবই বিনিয়োগ হিসেবে। ইউক্রেনকে আমেরিকাসহ পশ্চিমা মিত্ররা কোটি কোটি ডলার, অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে। কেন করছে? যুদ্ধে ইউক্রেন জয় লাভ করলে তা কড়ায় গন্ডায় আদায় করবে ইউক্রেনের কাছ থেকে। যুদ্ধে পরাজিত হলেও আদায় করবে। তাবত বিশ্বই অর্থকে প্রাধান্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিচারের মালিক টাকা এ কথা শুধু যে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সত্য তা নয়, সারা পৃথিবীই বিচারের মাফকাঠি হিসেবে নিজ নিজ দেশের অর্থ বা টাকাকে বিবেচনা করে থাকে। দেখুন না, কোনো আসামির কারাদণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা হয়। অর্থ অনাদায়ে কারাদণ্ডের মেয়াদ বাড়ানো হয়। কেন এ রকম বিচারব্যবস্থা? তার মানেটা হচ্ছে- টাকাই বিচারের মালিক। আর সে জন্যই অর্থ উপার্জনের ভয়ানক প্রতিযোগিতা চলছে এ পৃথিবীতে।

লেখার শুরুতে আমি বলেছি পৃথিবীটা বদলে যাচ্ছে। মোদ্দাকথা, অধিক অর্থ রোজগারের নতুন নতুন পথ সৃষ্টির জন্যই এই বদলে যাওয়া। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিদ্যুৎ ও বায়োসায়েন্সের সাহায্যে অধিক বিত্ত অর্জনের উপায় বের করতে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালাচ্ছে। এতে সফলও হচ্ছে। বিশ্বে যে, এই সফলতার দিকে যত বেশি অগ্রসর হতে পারবে, সে তত বেশি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সৃষ্টি করবে। ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এর প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকবে। আমাদের জনগণকে অবশ্যই বিষয় ও ব্যক্তির জন্য আরও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে চিন্তা করতে ও অনুভব করতে শিখতে হবে। ভগিনী বিধবা হয়েছে, ভাইদেরই এগিয়ে আসতে হবে, তার শোচনীয় অবস্থাতে সাহায্য করতে, সেবা করতে, তার সঙ্গে প্রতারণা করতে নয়। এরকম নীচতা থাকা উচিৎ নয়। যতই বলি টাকা বিচারের মালিক, কিন্তু স্থিত-প্রজ্ঞ দৃষ্টির কাছে টাকার কোনো মূল্য নেই। আপাতত দৃষ্টিতে টাকাই সবকিছু মনে হলেও জীবনের প্রকৃত সাফল্য আসে মানসিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে। টাকা মনকে চঞ্চল করে। চঞ্চল মন কোনো মহৎ কাজ করতে পারে না। কাজেই বিচারের মালিক টাকা বা বিত্ত হলেও শেষ বিচারে টাকাই সব অবিচারের অণুষজ্ঞ হয়ে উঠবে। পৃথিবী তখন আবার বদলে যাবে। ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর এটাই নিয়ম। চলমান অর্থনীতির কূটনীতিও টাকা রোজগার কেন্দ্রিক বদলে যাওয়া পৃথিবীতে এ সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটবে। টাকার মানটাও হ্রাস পাবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত