ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নৈতিক শিক্ষার পাঠ আবশ্যিক করা প্রয়োজন

ড. মো. শওকত হোসেন, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
নৈতিক শিক্ষার পাঠ আবশ্যিক করা প্রয়োজন

শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়ে থাকে। তবে সে শিক্ষাকে অবশ্যই হতে হবে সুশিক্ষা। সুশিক্ষিত নাগরিক একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমাদের দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। কিন্তু সুশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা খুব বাড়ছে- এমন বলা চলে না। আমাদের তরুণ সমাজ অনেক দিক দিয়ে অগ্রসরমান হলেও তাদের নৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করার নিশ্চয়তা নেই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায়। শিক্ষিত তরুণরা ভোগবাদী সংস্কৃতির ধারক হচ্ছে নানাভাবে। ভোগবাদী মানুষ অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারে সহজেই। আমাদের তরুণরা ক্রমেই নানারকম অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ছে। তাই নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে তাদের চারিত্রিক উন্নয়নের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা দরকার। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের তরুণ সমাজের নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিলে সেই জাতির ভবিষ্যৎ শঙ্কাপূর্ণ হয়ে ওঠে। মানুষের চরিত্র মন্দ হলে কোনো আইন-কানুন দ্বারা তাকে খুব একটা আটকে রাখা যায় না। তাই চরিত্র গঠন বা চারিত্রিক উন্নয়নের দিকে নজর দেয়া উচিত সর্বাগ্রে। মানুষের নৈতিক জীবন গড়ে ওঠে বাল্যকাল থেকেই। বলা চলে বাল্যকালের শিক্ষা ও অভ্যাসই মানুষের সমগ্র জীবনে প্রভাব ফেলে। শিশুকাল থেকেই চরিত্র গঠনের বিশেষ শিক্ষা পেলে মানুষ সুন্দর নৈতিক জীবনের দিকে অগ্রসর হতে পারে। এজন্য শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে নৈতিক শিক্ষার বিশেষ পাঠ থাকা জরুরি।

শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে, শিশুরা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়, তাদের শিক্ষকদের দ্বারা এবং পাঠ্যপুস্তক দ্বারা। পাঠ্যবইয়ের লিখিত বিষয়কে তারা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং শিক্ষকের নির্দেশনাকে তারা পিতামাতার নির্দেশনার চাইতেও বেশি অনুসরণযোগ্য বলে মনে করে। তাই স্কুল পর্যায়ে নৈতিক শিক্ষায় পাঠ থাকলে ছোটবেলা থেকেই একটি শিশু ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারে। ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করলে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার শিক্ষা ছোটবেলা থেকে পেলে সেই মানবশিশুর অন্তরে সেটা দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায় এবং এই শিক্ষা তার সমগ্র জীবনকে প্রভাবিত করে।

আমাদের দেশের বর্তমান স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রমে নৈতিক শিক্ষার কোনো স্বতন্ত্র পাঠ নেই। আমাদের ছোটবেলায় বাল্যশিক্ষার বইয়ে অনেক নীতিকথা ছিল। আজও সেখানের অনেক নীতিবাক্য আমাদের জীবনকে কম বেশি প্রভাবিত করে। কিন্তু প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে স্কুল শিক্ষা কার্যক্রমের এমনকি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কোথাও আজ নৈতিক শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। উচ্চশিক্ষায় একমাত্র দর্শনের অন্তর্গত ‘নীতিবিদ্যা’ নামক একটি কোর্স পড়ানো হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রীতি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো করে ব্যবসায় নীতিবিদ্যাসহ প্রায়োগিক নীতিবিদ্যার কিছু দিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা শুরু হয়েছে। এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ভালো। তবে নীতিশিক্ষার এ পাঠ শিশু-কিশোর পর্যায়ে পেলে সেই শিক্ষা আরও বেশি কার্যকর হতো।

শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট অনুযায়ী প্রণীত শিক্ষানীতিতেও নৈতিক শিক্ষাকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে কার্যত নৈতিক শিক্ষা আর ধর্মশিক্ষাকে একসঙ্গে করে ফেলা হয়েছে। ধর্মশিক্ষা অবশ্যই জরুরি। এতে করে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ধর্মের মূল শিক্ষা কল্যাণকর। তাই ধর্মশিক্ষা পাঠ্যসূচিতে আবশ্যিক হিসেবেই থাকা দরকার। তবে নৈতিক শিক্ষাকেও স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে আবশ্যিক করা জরুরি। এতে করে সব শিক্ষার্থীকে সর্বজনীন বা কমন কিছু চারিত্রিক শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

প্রাক-প্রাথমিক স্তরে কিছু নীতিবাক্য, প্রথম শ্রেণি থেকে কিছু নীতিশিক্ষামূলক কবিতা গল্প এবং পর্যায়ক্রমে সত্যবাদিতা, সহমর্মিতা, পরমতসহিষ্ণতা, ক্ষমা, পিতামাতার প্রতি কর্তব্য, দেশের প্রতি কর্তব্য, মানবসেবা, সৃষ্টজগতের প্রতি দায়িত্ব, ন্যায়বিচার, পরপোকার ইত্যাদি সদগুণগুলোর ওপর বিভিন্ন শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেয়া হলে নিঃসন্দেহে তা তাদের জীবনে প্রভাব ফেলবে।

যেকোনো কাজ করতে হলে যেমন- সেই কাজের প্রকৃতি, পদ্ধতি ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানা জরুরি। তেমনি নৈতিক আচরণ করতে হলেও জানা দরকার, কোন ধরনের কাজ নৈতিক এবং কোন ধরনের কাজ অনৈতিক। বস্তুত জ্ঞানের সঙ্গে মানুষের চিন্তা, কর্ম ও বিশ্বাসের রয়েছে নিবির সম্পর্ক। ভুবন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক জ্ঞানগুরু সক্রেটিস মনে করতেন : ‘জ্ঞানই পুণ্য’। তিনি তার শিষ্যদের বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, অজ্ঞানতাই সব অপকর্ম বা অশুভ কর্মের মূল কারণ। তাই সবারই প্রকৃত সত্যের সন্ধান লাভ বা যথার্থ জ্ঞান অর্জন করা জরুরি। যে ব্যক্তি যথার্থ জ্ঞানী সে ব্যক্তি অন্যায় কাজ করতে পারে না। আমরা হয়তো মনে করি যে, যারা অন্যায় কাজ করে তারা তো জেনে শুনেই অনেক সময় অন্যায় করে থাকে। কিন্তু সক্রেটিসের ব্যাখ্যা ভিন্ন। তিনি মনে করেন যে, যারা অন্যায় করে, তারা আপাত দৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানী বলে মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে ওই বিষয়ের আদি-অন্ত বা তার জীবনে তার চূড়ান্ত প্রভাব সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত নন। সক্রেটিস সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, অন্যায় কাজ কোনো ব্যক্তির জীবনে চূড়ান্তভাবে ভালো ফল বয়ে আনে না। কোনো না কোনোভাবে সে ওই অন্যায় কাজের জন্য মন্দ-ফল ভোগ করে থাকেন।

আমাদের কোমলমতি শিশুদেরও যদি এটা বোঝানো যায় যে, ভালো কাজই জীবনকে সুন্দর, শান্তিময় করে, আর মন্দ কাজ জীবনকে কণ্টকাকীর্ণ করে তোলে- তাহলে অবশ্যই তারা ভালো কাজে উৎসাহী হবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করবে। এই প্রক্রিয়াটি যদি ছোটবেলা থেকে কারও অভ্যাসে পরিণত হয়, তাহলে এটি হবে তার চরিত্রের অংশ। সৎচরিত্র চলতে অ্যারিস্টটল ভালো কাজ করার অভ্যাস ও প্রবণতাকেই বুঝিয়েছেন। ছোটবেলা থেকে ভালো কাজের অভ্যাস ও প্রবণতা সুদৃঢ় হলে তার শুভ প্রভাব সারা জীবনে থাকাটাই স্বাভাবিক। আমরা যদি নতুন প্রজন্মকে ছোটবেলা থেকে এমনটি ভালো কাজ, ভালো চিন্তায় অভ্যস্ত করতে পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের অবস্থা হয়তো বদলে যাবে। আসলে আমাদের মত দুর্নীতির ঘুণে ধরা ঘোর তমসাচ্ছন্ন সমাজের স্বরূপ বদলাতে হলে এই সমাজের নবীন সদস্যদের নিষ্কলুষ অন্তরে বপন করতে হবে, শুভচেতনা ও সুনীতির বীজ। পর্যায়ক্রমে উচ্চশিক্ষার সব ক্ষেত্রেই নৈতিক শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। কেননা, যে বিদ্যাই শেখানো হোক, তার সঙ্গে নৈতিকতার পর্যাপ্ত শিক্ষা না থাকলে পেশাগত বা প্রাত্যহিক জীবনে মানুষ অর্জিত বিদ্যাকে যথাযথ কল্যাণকর্মে প্রয়োগ করতে পারবে না।

নীতিদার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের অধিকাংশের মতে, মানুষের মধ্যে ভালো হওয়ার প্রবণতারই প্রাধান্য রয়েছে। দরকার সেই প্রবণতার লালন এবং ভালো চিন্তা ও ভালোকর্মের সুযোগ সৃষ্টি ও উৎসাহ প্রদান। তাহলেই মানুষ কাঙ্ক্ষিত মানবচিত কাজ করতে সদা সক্রিয় থাকবে। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী। মানুষের সংজ্ঞায় অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব’। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি-যুক্তিযুক্ত ও বিবেকপ্রসূত কাজের প্রতিই আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতার ধারক। তবে মানুষের মধ্যে সেই যুক্তিবাদিতা ও বিবেকবোধ জাগ্রত করা জরুরি। এ বিষয়ে সহায়তা করার জন্য শিক্ষা-কার্যক্রমে বিশেষব্যবস্থা থাকা দরকার। যে শিক্ষা মানুষের মানবিকতাকে জাগ্রত করে, সে শিক্ষা সব মানুষের জন্যই কাম্য। তবে অনেকটা দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে এবং বিশ্বের অনেক স্থানে আজ মানুষ অণ্ণ, বস্ত্র, বাসস্থানসহ তথকথিত উন্নত জীবনের বস্তুগত সামগ্রী অর্জনের নিমিত্তে অধিক মুনাফা লাভের বিদ্যার পেছনে যতটা ছুটছে মানবিকতার উন্নয়নমূলক শিক্ষার বিষয়ে কারও সে রকম আগ্রহ নেই। আজকের বিশ্বে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যাণে সভ্যতার অনেক উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু চরিত্রগত বা নৈতিক দিক থেকে আমরা এক বিভীষিকাময় অবস্থায় নিমজ্জিত। মানবিকতা, ন্যায়-নীতি, এগুলো যেন যন্ত্রের জাঁতাকলে আটকে পড়েছে। বিশ্ববিবেক আজ ভোঁতা। মানবতা পদদলিত। যন্ত্রশক্তির মতো মানুষ আজ পশুশক্তিতে বলবান হওয়ার অশুভ প্রতিযোগিতায় উন্মুক্ত হয়ে ওঠেছে। এক উগ্র ভোগবাদী মানসিকতা গ্রাস করে ফেলছে গোটা মানবসমাজের অতীত অর্জন, বর্তমান মঙ্গলকর প্রয়াস এবং ভবিষ্যতের শুভ সম্ভাবনাকে। মানুষে মানুষে শুভ সম্পর্ক-সহযোগিতার বাঞ্ছিত প্রয়োজনে গঠিত হয়েছিল সমাজ, রাষ্ট্র। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে মানব সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে সংকট চলছে, বিবাদ-সংঘাতের যে অবাঞ্ছিত মহড়া চলছে, তাতে প্রাক-সামাজিক অবস্থাই আবার ফিরে আসবে বলে সন্দেহ হয়। সঠিক জীবনদর্শনের অভাবে মানুষ আজ বিভ্রান্ত। মানবতা জাগ্রত করতে পারে, এমন কিছু চর্চা থেকে মানুষ আজ বিমুখ। সে কারণেই মানুষের জীবন আজ হয়ে উঠেছে- নীতিহীন, মূল্যবোধহীন। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতির বিপুল সম্ভার মানুষের জীবনকে সুন্দর ও স্বার্থক করার বদলে অনেক ক্ষেত্রেই করে তুলছে সংকটাপন্ন। এই পরিপ্রক্ষিতে নৈতিকদর্শন চর্চার বিকল্প নেই। সঠিক নীতিশিক্ষাই পারে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে মানবিক প্রয়োজনে যথার্থভাবে কাজে লাগানোর নীতিনির্ধারণ করতে।

জীবনে সম্পদের প্রাচুর্য যতই থাকুক না কেন, সঠিক জীবনদর্শন ছাড়া মানবজীবন সুন্দর ও স্বার্থক হতে পারে না। তেমনি দুনিয়াজুড়ে যত ধরনের যান্ত্রিক শক্তিই আবির্ভূত হোক, সুখময় জীবনযাপনের উপাদন-উপকরণ যতই বেড়ে চলুক, সঠিক নীতি বা দিকনিদের্শনা ছাড়া দুনিয়ার বুকে শান্তি আসতে পারে না। টেকসই অর্থনীতি, দরিদ্র দূরীকরণ শান্তির সহায়ক- সন্দেহ নেই। কিন্তু অর্থনীতির সঙ্গে সুনীতি সমন্বিত না হলে কাঙ্ক্ষিত শান্তি ও প্রগতি অসম্ভব হয়ে পড়ে। নীতিশিক্ষার পর্যাপ্ত পাঠ স্কুল পর্যায় থেকে প্রদান করলে আমাদের নতুন প্রজন্ম সুনীতি চর্চায় উৎসাহিত ও অভ্যস্ত হওয়ার সুযোগ পাবে। আর এভাবেই আমাদের নৈতিকসংকটময় ক্ষয়িষ্ণু সমাজে সূচিত হতে পারে এক আর্দশিক বিপ্লব- যে বিপ্লব মানুষকে শান্তিময় কল্যাণকর জীবনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত