ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কালের কড়চা

গণতান্ত্রিক ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, [email protected]
গণতান্ত্রিক ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অবস্থান প্রথম কাতারে। কেননা, স্বাধীনতা লাভের পর আজ পর্যন্ত দেশটিতে সামরিক শাসন আসেনি। সামরিক শাসন না এলেও কোন দেশ গণতান্ত্রিক হবে, সেটি কোনো কথা নয়। মিলিটারি শাসন ব্যতীতও অগণতান্ত্রিক হতে পারে- এ রকম উদাহরণ পৃথিবীতে রয়েছে। এ লেখায় আমি সে উদাহরণ টানতে চাই না। ভারত কীভাবে গণতান্ত্রিক এবং প্রজাতন্ত্রে অভিসিক্ত, সে ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে কিছু ঐতিহাসিক সত্য তুলে ধরব। তারপর মূল বিষয়ে আলোকপাত করব। ভারত দুটি সনাতনি আদর্শ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প করেছিল। একটি হচ্ছে ক্ষুদ্র অহংভাব ত্যাগ এবং অন্যটি সেবার ভাবে উদ্বুদ্ধ হওয়া। এর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, মানুষ এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক তার রূপটি ওই দুটি আদর্শের ওপর ভিত্তি করে বিকশিত হলে সাধারণের সুখ ও সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত হতো। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায়, ভারতবর্ষের মানুষ বরাবরই নিজেরাই নিজেদের শোষণ করেছে, বঞ্চনা করেছে, প্রতারণা করেছে। যে ধরনের শোষণের সঙ্গে আমরা সাধারণত পরিচিত, তা হলো অর্থনৈতিক শোষণ যার ওপর দার্শনিক ও রাজনীতিক কার্লমার্কস এবং তার অনুগামীরা আলোকপাত করেছেন। তবে শোষণ আরও নানা ধরনের হতে পারে। অর্থনৈতিক শোষণ একটি অনভিপ্রেত দিক। অন্যদিকে একজন মানুষ তার অতিরিক্ত শক্তি, মেধা এবং ক্ষমতাকে অন্যের সেবায় অন্যের উন্নতি বিধানের কাজেও লাগাতে পারেন। প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের মানুষ কেন গঠনমূলক সেবা ও উন্নতির দৃষ্টিভঙ্গিকে বেছে নিতে পারেনি? যদি পারতও তবে ভারতই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যেত। যদিও বর্তমানে ভারত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই পরিত্যাগ করে এগিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর আগে স্বামী বিবেকানন্দ বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন : ‘ভারত বর্ষের জাতীয় আদর্শ হলো সেবা ও ত্যাগ। এই পথেই তাকে উত্তরোত্তর চালিত করলে বাকি সব আপনা-আপনিই আসিবে। (The complete works of Swami Vivekananda. 1997. Vol-5, P-228) বিগত ঊনিশ শতকে জাতীয় নবজাগরণের কালে ভারতবাসীকে এই ত্যাগ ও সেবার ভাব দ্বারা অণুপ্রাণিত করেছিল। ভারত বর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে আবির্ভাব হয়েছিল দেশব্রতী আত্মত্যাগী কর্মীর, যারা দেশের স্বাধীনতা ও জাতি গঠনের পবিত্র কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের আত্মনিবেদনের ফলে কয়েক শতাব্দীর জড়তা ও দাসত্বের অবসান ঘটিয়ে ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু তারপর কেন যে, ভারতবাসী সেই মহান ভাব ও উদ্দীপ্ত মানসিকতাকে অব্যাহত রাখতে পারেনি, সেটি এক বিড়াট রহস্য। কয়েক শতাব্দীর দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে স্বাধীনতার আলোকোজ্জ্বল প্রভাতে উত্তীর্ণ হয়ে ভারতের মানুষ কত সহজেই যে ইতিহাসের শিক্ষা ও সতর্ক বাণীগুলো ভুলে গেল, তা ভাবতেও অবাক লাগে! হারিয়ে যায় সৃজনশীল চরিত্র। অথচ ইতিহাসে অজস্র দৃষ্টান্ত আছে, যেখানে দেখা যায়, বহু জাতি রাজনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সৃজনধর্মী উদ্যমে মেতে উঠেছে। এথেন্স তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ঐক্যবদ্ধ ও লাগাতার সংগ্রামের দ্বারা যখন পারস্যের অণুপ্রবেশকারীদের পরাস্ত করে, তাদের স্বল্পস্থায়ী; কিন্তু গভীর যন্ত্রণাদায়ক গোলামির হাত থেকে মুক্ত করে। এথেনীয় গণতন্ত্র তখনই স্বাধীনতার অপার আনন্দ আস্বাদনে তৎপর হয়ে ওঠে। সে আনন্দের উদ্দীপনায়, পরবর্তী সময়ের ৫০ বছরে তাদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক রাজনৈতিক, শৈল্পিক এককথায় জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে সংঘটিত হয় সৃজনশীলতার এক মহান বিস্ফোরণ; যা শুধু এথেনীয়দেরই নয়, উপরন্তু সমগ্র পাশ্চাত্যের উত্তরকালের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করে তোলে। ভারত কেন স্বাধীনতা লাভের পর সেই আনন্দের অবিরাম প্রবাহকে উপভোগ করতে পারেনি? এথেনীয়দের মতো স্বল্পকালীন দাসত্বের পর তো ভারত স্বাধীনতা পায়নি। ভারত স্বাধীনতা পেয়েছে কয়েক শতাব্দীর পরাধীন কালের পর। স্বাধীনতা লাভের কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতের সৃজনশীল শক্তির উৎসগুলো শুকিয়ে যায়। এর পরই ফিরে যায় আগের অচলবস্থায়, নিমজ্জিত হয় চূড়ান্ত স্বার্থপরতার গভীর সাগরে। আত্মকেন্দ্রিকতাকেই জীবনের সারবস্তু হিসেবে গ্রহণ করে ভারতবাসী। অতিসংক্ষিপ্ত স্বাধীনতা উত্তর-ইতিহাসের এ হচ্ছে করুণ পরিণতির মূল্যস্বরূপ সহ্য করতে হয়েছে নানা বিপর্যয়, অর্থনৈতিক দুর্বিপাক, রাজনৈতিক অনৈক্য এবং সামাজিক সংকট। যেখানে সবাই নিজের সুখকে বড় করে দেখে; সেখানে কেউ যথার্থ সুখী হতে পারে না। ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবসে কথাগুলো বলতে হলো এ জন্যই যে, ভারতের সেবা ও ত্যাগের বোধ কী জেগে উঠেছে? সৃজনশীল শক্তির উৎস কী আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে? হয়তো নবশক্তি সঞ্চারে ভারত সনাতনী আদর্শকে ধারণ করে এগিয়ে যাবে।

ফিরে আসছি প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্রের কথায়। ভারত বর্ষ হচ্ছে সার্বভৌম-সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের দেশ। ১৯৫০ সাল থেকে ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য, ভারত স্বাধীনতা লাভের প্রায় ২ বছর পর অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান অনুমোদন লাভ করে। কিন্তু ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে কার্যকর হয়। এর মধ্যে আরও একটি বিষয় হচ্ছে- স্বাধীনতার আগে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক পূর্ণ স্বরাজের সংকল্প ঘোষিত এবং গৃহীত হয়েছিল। এ দিনটিকে স্মরণ রাখার জন্য ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করা হয়। প্রজাতন্ত্র হচ্ছে- এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতাভোগ করবে জনগণ বা জনগণের একাংশ। কোনো রাজা-রানি, এরকম সরকার ব্যবস্থায় সরকার প্রধানের পদটিতে অলংকৃত হন না। প্রজাতন্ত্র, ইংরেজিতে Rupublic লাতিন শব্দবন্ধ ruspublica শব্দবন্ধটি থেকে এসেছে Rupublic শব্দটি। যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে জনগণ সংক্রান্ত একটি বিষয়, প্রাচীন ও আধুনিক প্রজাতান্ত্রিক নিজস্ব আদর্শ ও গঠন অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। সাধারণত রাজশক্তিহীন রাষ্ট্রকেই প্রজাতন্ত্র বলা হয়। আবার গণতন্ত্র বলতে কোনো জাতি রাষ্ট্রের এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক এবং সদস্যের সমানভাবে ভোটাধিকার থাকে। ইংরেজি ‘Democracy’ শব্দটি গ্রিক শব্দ Demokrita থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা গ্রিক শব্দ ‘Demos’, এবং ‘Kratia’ শব্দ দুটির সমন্বয়ে সৃষ্ট। ‘Demos’ শব্দের অর্থ জনগণ, আর Kratia শব্দের অর্থ হলো- শাসন, গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সব নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে, যা সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়ে থাকে। ‘গণতন্ত্র’-এর পরিভাষাটি সাধারণভাবে একটি রাজনৈতিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হলেও অন্যান্য সংস্থা বা সংগঠনের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হতে পারে। তবে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাকে নানা সময়ে বিভিন্ন উপায়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, খ্রিষ্টপূর্ব ৪২২ সালে গ্রিক দার্শনিক ক্লিয়ান ডেমোক্রেসিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- That shall be the demoratic which shall be the people, for the people-এর বহুকাল পরে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী (পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট) আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর Pennsylvania State-এর গোটিসবার্গ বক্তৃতাতে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন এভাবে- ‘Government of the people, by the people for the people’ যার বাংলা তরজমা হচ্ছে- গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য। এটি সর্বকালের সেরা ও আধুনিক গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। অধ্যাপক গেটেলের মতে, ‘যে শাসনব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগে অংশ নেয়ার অধিকারী সেটাই গণতন্ত্র।’ মোদ্দাকথা, জনগণ বা নাগরিকের ইচ্ছামাফিক যে সরকার ব্যবস্থা প্রণীত হয়, তাই গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণই সর্বময় ক্ষমতা ও রাষ্ট্রের মালিক। গণতন্ত্রে যারা সরকার পরিচালনা করেন, তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। রাষ্ট্রের সব কর্মচারী-কর্মকর্তাও জনগণের কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য। একজন সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষও যদি কোনো রাস্তার কাজে ত্রুটি চিহ্নিত করে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে কৈফিয়ত চান, তবে কৈফিয়ত দিতেই হবে। এটিই গণতান্ত্রিক চর্চা। কিন্তু প্রজাতন্ত্রে সংবিধানের আলোকে জনপ্রতিনিধি রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্র একটি অপরটির পরিপূরক। ‘প্রজা, এবং ‘গণ’- এ দুটি শব্দের শেষেই ‘তন্ত্র’ যুক্ত হয়েছে। এখানে ‘প্রজা’ শব্দের অর্থ রাষ্ট্রের বা জমিদারির অধিবাসি, রায়ত; বা ভাড়াটে। ব্যাকরণ অনুসারে ‘তন্’ ধাতু নিষ্পন্ন শব্দটি হচ্ছে ‘তন্ত্র’ যার অর্থ বিস্তার দেহ-মন ও চিন্তার বিস্তারই ‘তন্ত্র’। রাষ্ট্রে প্রজার চিন্তার বা চেতনার বিস্তার ঘটে সংবিধানে। অন্যদিকে ‘গণ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘জনসাধারণ’ শ্রেণিভেদে ‘গণ’ এর বহুমুখী অর্থ রয়েছে। ‘গণ’ এর সঙ্গে তন্ত্র যুক্ত হয়ে গণতন্ত্র হয়েছে। সে হিসেবে জনগণের চিন্তা-চেতনার বিস্তার লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয় গণতন্ত্রে। প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্র এক মোহনায় মিলিত হয় ভিন্ন ভিন্ন রাস্তায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিক ‘প্রজাতন্ত্র’ রাষ্ট্র। একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক হয়ে উঠার অর্থ, সেই রাষ্ট্রের মানুষ নাগরিক হিসেবে তাদের রাজনৈতিক ভাগ্যের নিয়ন্তা হয়ে উঠবে। সে অর্থে ভারত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কারণ ভারতবাসী তাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য আইনসভাগুলো নানা ধরনের শ্রমিক আইন পাস করে শ্রমজীবীদের স্বার্থরক্ষা ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে উন্নত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এ যাবৎ যা করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। তবে ধীর লয়ে হলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক গণতন্ত্রে পরিণত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে ভারত। মনে রাখা দরকার মানুষের বিবর্তন দৈহিক নয়, মনোসামাজিক। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কর্ম ধারার মাধ্যমে তা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ বিবর্তনে স্বজাতির বিস্তার এবং মানসিক ক্রিয়াশীলতা ও তার ফলাফলের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটে। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস যে লক্ষ্য নিয়ে পালিত হয়ে আসছে তা হচ্ছে- বহুজাতিক ভারতের জাতীয় ঐক্যের নীতিকে সুসংসত ও শক্তিশালী করা। বিশ্বমানবতা বিকাশে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখুক- এটাই প্রত্যাশা করছি ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবসে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত