খনিজ সম্পদ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত

প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পেট্রোলিয়াম নামক আমাদের এই মহামূল্যবান বন্ধুটির জন্ম হলো কী করে, কোথায় এর জন্মস্থান বা আঁতুড়ঘর তা নিয়ে ভূবিজ্ঞানীরা নানা সময় সংশয় প্রকাশ করেছেন। হলফ করে কেউ বলতে পারেননি, খনিজ তেলের জন্ম কী করে হলো। খনিজ তেল তথা পেট্রোলিয়াম শব্দটি লাতিন ভাষা, যা বিশ্লেষণ করলে অর্থটা দাঁড়ায় ‘পেট্টো’ অর্থাৎ পাথর ও ‘ওলিয়াম’ মানে তেল, পাথর নিংড়ে যে তেল পাওয়া যায়, সেটাই পেট্রোলিয়াম। আধুনিক সভ্যতার চাকা চালু রাখার জন্য পেট্রোলিয়াম বর্তমানে এতই প্রয়োজনীয় যে, এ সভ্যতাকে পেট্রোলিয়াম সভ্যতা বলতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কেউ কেউ আদর করে খনিজ তেলকে তরল সোনা বলেও থাকেন।

পাহাড়ে, জঙ্গলে, সমুদ্রের নিচে খনিজ তেলের সন্ধানে গিয়ে ভূতাত্ত্বিকরা লক্ষ্য করেছেন পেট্রোলিয়ামবাহী বেশিরভাগ শিলাস্তরের উপরেই রয়েছে অপ্রবেশ্য শিলাস্তর, অনেকটা বোতলে মুখের ঢাকনার মতো, যাতে পেট্রোলিয়াম বা প্রাকৃতিক গ্যাস অন্য পাথরের ভেতর দিয়ে গেলে বেরিয়ে গিয়ে নষ্ট হতে না পারে। প্রকৃতি তার নিজের হাতে তৈরি জেলখানায় বন্দি করে রেখেছে পেট্রোলিয়ামবাহী শিলাস্তরকে মানব জাতির কল্যাণের জন্য।

লাখ লাখ বছর আগে ভূগর্ভের অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের ভেতর ধীরে ধীরে এই অমূল্য সম্পদের সৃষ্টি হয়েছিল মহাজাগতিক কোনো কর্মকাণ্ডের ফলে, তারপর পুনঃরায় নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে, এমন কোনো খবর জানা নেই।

ভূগর্ভে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, সালফার এবং সীসার সংমিশ্রণে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে হাজার হাজার বছর আগে তৈরি হয়েছিল তেল ও গ্যাস। প্রকৃতির দান করা এই অমূল্য সম্পদকে গোটা পৃথিবী ব্যাপী অবিবেচকের মতো যথেষ্ট ব্যবহারের গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য করে জরুরিভিত্তিতে কী করে অপব্যবহার রোধ করা যায়, সেই লক্ষ্যে দেশের রাষ্টনায়ককরা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে শুরু করেছেন, বিশেষ করে যেসব দেশগুলো প্রকৃতির এই দয়া থেকে বঞ্চিত, অশনি সংকেতের আশায় কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে অনেক দেশের রাষ্ট্রনায়কদের। আমাদের দেশে ভূগর্ভে সঞ্চিত পেট্রোলিয়াম ভান্ডার তুলনামূলকভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় যেহেতু নগণ্য, তাই গ্যাস ও তেল মন্ত্রণালয় থেকেই তেল কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে প্রচার শুরু করে চলেছেন গোটা দেশজুড়ে।

সভ্যতার অগ্রগতি বজায় রাখতে হলে আমাদের অবশ্যই খনিজ তেল ও গ্যাসের ব্যবহারে সংযমী হতে হবে। এ বিষয়ে মতানৈক্য থাকতে পারে না। তবে সচেতনতার অভাবে অপচয় বা অপব্যবহার রোধ করে নিজের ও দেশের স্বার্থে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে খনিজ তেল ও গ্যাস তথা এ অমূল্য সম্পদের ব্যবহার করতে হবে। কারণ, যদি অবিবেচকের মতো এর ব্যবহার করার প্রবণতা রোধ করা না যায়, তবে অচিরেই ভূগর্ভে সঞ্চিত খনিজ গ্যাস-তেলের ভান্ডার ফুরিয়ে যাবে। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, যে দেশ দুর্ভাগ্যবশত প্রকৃতির এই কৃপা থেকে বঞ্চিত।

বিশ্বের নানা দেশে ভূগর্ভে যে পরিমাণ খনিজ তেল আছে, সেই পরিমাণের সামান্যই আমাদের দেশে আছে। এক সমীক্ষার রিপোর্টে জানা গেছে গোটা বিশ্বে ভূগর্ভে মজুত তেল ও গ্যাসের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৯৩৫ কোটি মেট্রিক টন এবং লক্ষকোটি ঘনমিটার। বেহিসাবিভাবে এ খনিজ তেলের ব্যবহার অব্যাহত থাকলে ভূগর্ভে মজুত ভান্ডার ফুরিয়ে যেতে মাত্র কয়েকবছর সময় লাগবে। আমাদের দেশে খনিজ তেলের চাহিদা সূচি ঊর্ধ্বমুখী। চাহিদার জোগান দিতে বর্তমানে আমাদের বিদেশ থেকে খনিজ তেল আমদানি করতে হচ্ছে ডলারের বিনিময়ে। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে খনিজ তেল এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার জোগান দিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ক্রমাগত বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হতে থাকলে অর্থনৈতিক কাঠামো দুর্বল হতে বাধ্য।

পৃথিবীব্যাপী বিজ্ঞানী ও ভূতাত্ত্বিকরা দিন-রাত নিরলসভাবে গবেষণা করে চলেছেন নতুন তেল ভান্ডারের। কোথাও ব্যর্থ হচ্ছেন আবার কোথাও সফল হচ্ছেন। খনিজ তেলের বিকল্প পথ উদ্ভাবন করতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যদিও বিকল্প জ্বালানি শক্তি হিসেবে সোলার পাওয়ার ব্ল্যান্ডেড বায়ো-ডিজেল, পানিবিদুৎ, বায়ুশক্তি ব্যবহার এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

বহু প্রাচীনকাল থেকেই পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যের ব্যবহার শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়। প্রায় ৬০০০ বছর আগে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে (অধুনা ইরাকে) পেট্রোলিয়ামের ব্যবহার হতো বলে জানা যায়। বিজ্ঞানী ও ভূতাত্ত্বিকদের ধারণা ওই অঞ্চলেই সম্ভাবত গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর প্রথম তেল ক্ষেত্র।

আমাদের দেশে সিএনজিসহ পরিবহণ ক্ষেত্রে প্রায় ৬০ শতাংশ, শিল্পক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ, গৃহস্থালি ক্ষেত্রে ১৫-১৮ শতাংশ, কৃষিক্ষেত্রে নয় শতাংশ, বাকিটা অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া আমাদের দেশে যানজটে আটকে থাকার কারণে কোটি কোটি টাকার জ্বালানি নষ্ট হয়। অপরদিকে দিনে দিনে যানবাহনের সংখ্যা ও ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শুধু বাংলাদেশে কেন বিশ্বব্যাপী খনিজ তেল ও গ্যাসের ব্যবহার চাহিদা অনুযায়ী ক্রমাগত বেড়েই চলছে। সভ্যতার চাকা চালু রাখতে খনিজ গ্যাস-তেল আমাদের ব্যবহার করতেই হবে। তবে তা অবশ্যই খুব সচেতন হয়ে ব্যবহার করতে হবে, যেন আরও বেশি কিছুদিন খনিজ তেল ও গ্যাসকে সুরক্ষিত করে রাখতে পারি, যতদিন না পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে বিকল্প শক্তি পুরোপুরিভাবে ব্যবহার করতে পারি।

সমাজের একটা শ্রেণি অবিবেচকের মতো খনিজ তেল ব্যবহার করে গোটা সভ্যতাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পরোক্ষভাবে পৃথিবীর পরিবেশকে অসুস্থ করে তুলছে। যানবাহন, কল-কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া পরিবেশকে প্রতিনিয়ত দূষিত করছে। বায়ুমণ্ডল স্তরে ক্রমেই এর প্রতিফলন ঘটছে, বেড়ে যাচ্ছে চর্মরোগসহ নানাবিধ জটিল রোগ। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি বায়ুমণ্ডলের আঘাতপ্রাপ্ত ফুটো দিয়ে সরাসরি পৃথিবীতে আসার ফলে বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। গ্রিন হাউস গ্যাস ক্ষতিগ্রস্ত হবার ফলে ১৭৫০ সাল থেকে আজ অবধি তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এদিকে যানবাহন, কল-কারখানা থেকে নির্গত দূষিত ধোঁয়া ওজোন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য বায়ুমণ্ডলের স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়া মানে বরফ গলে পানি হয়ে পৃথিবীতে পানির ভাগ বেড়ে স্থলভাগকে ধীরে ধীরে ডুবিয়ে দেয়া, যদি তাই ঘটতে থাকে, তবে আমরা তো পানির নিচে ডুবেই যাব। তাই সব শ্রেণির জনসাধারণের উচিত নিজের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে হিসাব করে খনিজ তেল ও গ্যাস ব্যবহার করা। অতি সচেতন হয়ে ব্যবহার করা, অপচয় রোধ করা। সমীক্ষা রিপোর্টে জানা গেছে, প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ সাশ্রয় করা সম্ভব, যদি আমরা একটু সচেতন হয়ে প্রয়োজন ভিত্তিক খনিজ তেল ব্যবহার করি। যদি পুল কার ব্যবহার করি তবে অনেক তেলের সাশ্রয় হয়। সরকার পুল কার ব্যবহারের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারেন।

নিয়মিত সার্ভিসিং, উন্নতমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার, স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালালে, গৃহিণীরা যথাসম্ভব গ্যাসের ছোটো বার্নার ব্যবহার করলে, প্রয়োজন শেষ হলে চুলো নিভিয়ে রাখলে, রান্নার সরঞ্জাম তৈরি করে রান্না যদি প্রেসার কুকার বা ঢাকনা দিয়ে করেন, তবে প্রচুর পরিমাণ তেল ও গ্যাসের সাশ্রয় হবে। সরকারও রাস্তাঘাট, উড়াল পুল, কল-কারখানাসহ নানা ক্ষেত্রে উন্নতির ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্যোগ হাতে নিয়েছে বলে জানা গেছে, তবে কর্মক্ষেত্রে এধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

দেশের সুনাগরিক হিসেবে জাতীয় সম্পদ তথা তেল ও গ্যাসকে সচেতন হয়ে ব্যবহার করে চলাটা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, এ কথা ভুলে ভাবী প্রজন্মকে অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর বুকে ঠেলে দিলে আমাদের জবাবদিহি করতেই হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। তাই এখন থেকেই সবাইকে সাবধান ও সচেতন হওয়া উচিত।