ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার পূরণ

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২৩ পাস

সৈয়দ ফারুক হোসেন, রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২৩ পাস

দেশের সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে জাতীয় সংসদে বিল পাস করা হয়েছে। সম্প্রতি ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এই বিল পাস হওয়ার ফলে সবার জন্য পেনশন স্কিম চালু করার আইনি ভিত্তি তৈরি হলো। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ছিল সবার জন্য পেনশন চালু করা হবে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন হলো জাতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি উপহার। ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার অনুযায়ী সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। কোনো ব্যক্তিকে মাসিক পেনশন সুবিধা পেতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় ১৮ বছর বা তার বেশি বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সি সব বাংলাদেশি নাগরিক অংশ নিতে পারবেন। বিশেষ বিবেচনায় পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদেরও পেনশন স্কিমের আওতায় রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মাসিক পেনশন সুবিধা পেতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর চাঁদাদাতাকে ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিতে হবে। ১০ বছর চাঁদা দেয়া শেষে তিনি যে বয়সে উপনীত হবেন, সে বয়স থেকে আজীবন পেনশন পাবেন। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরাও এতে অংশ নিতে পারবেন।

পেনশনে থাকাকালে কোনো ব্যক্তি ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি অবশিষ্ট সময়ের জন্য (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেয়ার আগে মারা গেলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে। নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা অসচ্ছল চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে। বিলে সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশ নেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। তবে সরকার সিদ্ধান্ত না দেয়া পর্যন্ত সরকারি ও আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা এ পেনশন ব্যবস্থার আওতাবহির্ভূত থাকবেন। পেনশন তহবিলে জমা দেয়া অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন তোলার প্রয়োজন পড়লে চাঁদাদাতা আবেদন করলে জমা দেয়া অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তুলতে পারবেন। যা ফিসহ পরিশোধ করতে হবে। মোবাইলে আর্থিক পরিষেবা (এমএফএস) ও এজেন্ট ব্যাংকিংসহ সব অনলাইন পদ্ধতিতে এ ফি পরিশোধ করা যাবে। পেনশন থেকে পাওয়া অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে।

বিশ্বের প্রায় সব দেশেই অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণদের আর্থিক নিরাপত্তার লক্ষ্যে পেনশন কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশের পেনশন ব্যবস্থার লক্ষ্যও তাই। স্বাধীনতাণ্ডউত্তর বাংলাদেশে জনসংখ্যা, অর্থনীতি, শ্রমবাজার ও মানুষের জীবনপদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের পেনশন ব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে এই পদ্ধতি বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে বেশ অসংগতিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ যারা তাদের কর্মজীবনে দেশের অর্থনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, তাদের শেষ জীবনের আর্থিক নিরাপত্তা বিধান বা সহায়তা প্রদান যদি পেনশন ব্যবস্থার লক্ষ্য হয়, তবে সেই লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশের পেনশন ব্যবস্থা সক্ষম। তাই সরকারি চাকরিজীবীদের বাইরেও দেশের নাগরিকদের পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে যাচ্ছে সরকার। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সি মানুষের সংখ্যা ৪০ মিলিয়নের উপরে পৌঁছতে পারে। ২০২০ সালে এই বয়সি মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ মিলিয়ন। অর্থাৎ পরবর্তী সময়ে তিন দশকের প্রতি দশকে ১০ মিলিয়ন মানুষ বয়স্ক নাগরিকের কাতারে নাম লেখাবেন। এর আগে আইন ও বিধি প্রণয়ন এবং তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করবে সরকার।

সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্মী বা প্রতিষ্ঠানের চাঁদা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দেবে। মাসিক সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসী কর্মীরা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা জমা দিতে পারবেন। সুবিধাভোগীরা বছরে ন্যূনতম বার্ষিক জমা নিশ্চিত করবেন। অন্যথায় তার হিসাব সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যাবে এবং পরবর্তী সময়ে বিলম্ব ফিসহ বকেয়া চাঁদা দেয়ার মাধ্যমে হিসাব সচল করতে হবে। সুবিধাভোগীরা আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে চাঁদা হিসেবে বাড়তি অর্থ (সর্বনিম্ন ধাপের অতিরিক্ত যে কোনো অঙ্ক) জমা করতে পারবেন। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। এ ব্যবস্থা স্থানান্তরযোগ্য ও সহজগম্য অর্থাৎ কর্মী চাকরি পরিবর্তন বা স্থান পরিবর্তন করলেও তার অবসর হিসাবের স্থিতি, চাঁদা প্রদান ও অবসর সুবিধা অব্যাহত থাকবে। নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন কর্মসূচিতে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে। পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে। পেনশন কর্তৃপক্ষ তহবিলে জমা করা টাকা নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে (সর্বোচ্চ আর্থিক রিটার্ন নিশ্চিতকরণে)।

সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত কারণে অভাবতার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকারের কথা সংবিধানে বলা রয়েছে। এই আইনের আওতায় অর্থ বিভাগের অধীনে একটি ‘সর্বজনীন পেনশন অথরিটি’ গঠন করা হবে। পুরোপুরি আইটিভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠান সারা দেশের মানুষের পেনশন ব্যবস্থাপনা করবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কৌশলপত্রটি চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে এ পেনশন ব্যবস্থা ঘোষণা করবে। দেশের আপামর জনগণের জন্য বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী একটি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তার আলোকে এ কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার আলোকে প্রণীত কৌশলপত্রটির ওপর প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জরুরিভিত্তিতে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে অর্থ বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের আপামর জনগণের জন্য বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী একটি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তার আলোকে এ কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। কৌশলপত্রে অর্থ বিভাগ প্রথান তিনটি লক্ষ্য সংবলিত সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রবর্তনের প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো বৃদ্ধ বয়সে কর্মরত জনগোষ্ঠীর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং এর মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মানকে দরিদ্র্যসীমার ওপরে রাখা; নিম্ন আয়ের মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি করা এবং তাদের একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় এনে তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা; এবং ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে একীভূত করে সেটিকে বিনিযয়োগে রূপান্তর করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার মাধ্যমে মূলধন সঞ্চয়কে উৎসাহিত করা। বর্তমানে পেনশনের আওতা অনেক বৃদ্ধি করে সরকারি দপ্তরগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য সব স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার চাকরিকেও পেনশনযোগ্য করা হয়েছে। এভাবে পেনশনের ক্ষেত্রে একটি সমতার নীতি অনুসৃত হচ্ছে। অতীতে তা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর বহু কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুয়িটি স্কিমের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তারা অবসর গ্রহণকালে এককালীন যা পেয়েছেন, অনেক ব্যাংকে বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে সে অর্থে কায়ক্লেশে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বর্তমান ব্যাংকসহ সর্বত্র সুদের হার হ্রাস করায় তারা বর্তমান বাজারে নানামুখী অসুবিধার সম্মুখীন। তাই পেনশন বা অবসর-সুবিধার ক্ষেত্রে কিছু মানবিকতা ও ন্যায্যতার সঙ্গে এরই আগে এককালীন সুবিধা নিয়ে যারা অবসরে আছেন, জীবিতকালে তাদের একটি সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব রয়েছে। তাদের জীবিতকালে ‘চিকিৎসা ভাতা’ এবং ‘উৎসব ভাতা’ দেয়ার বিধানও রয়েছে। পেনশন ব্যবস্থা রাজস্বভিত্তিক। তাই পেনশন ব্যবস্থার সম্প্রসারণের কথা বললে অনেকে মনে করেন যে তা জাতীয় বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ ফেলবে। কিন্তু পেনশনের আওতা সম্প্রসারণ করলে বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ আবশ্যিক নয়। মৌলিকভাবে পেনশন একটি ইনস্যুরেন্স-ব্যবস্থা, যা বেতনভোগী কর্মজীবীদের কন্ট্রিবিউশনের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। কোনো কোনো দেশে কর্মচারীদের পাশাপাশি মালিক ও রাষ্ট্রও আংশিকভাবে ট্রিবিউন করে, যা মূল তহবিলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে আগামী ১ বছরের মধ্যে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করা। কৌশলপত্রে অর্থ বিভাগ প্রধান তিনটি লক্ষ্য সংবলিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমের প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো বৃদ্ধ বয়সে কর্মরত জনগোষ্ঠীর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং এর মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মানকে দারিদ্র্যসীমার উপরে রাখা; নিম্ন আয়ের মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি করা এবং তাদের একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় এনে তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা; এবং ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে একীভূত করে সেটিকে বিনিয়োগে রূপান্তর করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার মাধ্যমে মূলধন সঞ্চয়কে উৎসাহিত করা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত