ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণ
অলোক আচার্য, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, [email protected]
প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ন্যাটোর বিস্তার নিয়ে রাশিয়ার আপত্তি এবং ন্যাটোর এ যুদ্ধে জড়ানো বা না জড়ানো নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। সেই আলোচনা-সমালোচনা এখনও চলছে। যুদ্ধে দুইভাবে হয়। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে। ইউক্রেন যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করছে ইউক্রেন এবং পরোক্ষাভাবে যুদ্ধ করছে তার মিত্রদেশগুলো। এ যুদ্ধ এখন আরও বিস্তৃত হচ্ছে।
সম্প্রতি তা নতুন মাত্রাও পেয়েছে। ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের ন্যাটো জোটে যোগ দেয়ার প্রচেষ্টা করছে গত বছর থেকেই। উদ্দেশ্য মূলত ইউক্রেন যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সেরকম হলে এই সামরিক জোটের সহযোগিতা পাওয়া। কারণ ন্যাটো জোটভুক্ত কোনো দেশ আক্রান্ত হলেই তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। ফলে ন্যাটো জোটভুক্ত কোনো দেশকে সহজেই আক্রমণ করা সহজ কথা নয়। ইউক্রেন এখনও ন্যাটো জোটে যোগ দিতে পারেনি; কিন্তু ন্যাটোতে যোগ দেয়ার প্রচেষ্টা করছে যা রাশিয়ার ইচ্ছে নয়। আর এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন গতি পেয়েছে পশ্চিমা দেশের ভারী অস্ত্র সরবরাহের ঘোষণায়। ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল ন্যাটো নামের এ সামরিক জোট প্রতিষ্ঠিত হয়। এর বর্তমান সদস্য দেশ ৩০টি। জোটটির প্রতিষ্ঠার সময় সদস্য ছিল ১২টি রাষ্ট্র এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জোটের সদস্য দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ন্যাটোর বিস্তৃতি ঘটছে। উল্লেখ্য, ন্যাটোর সদস্যভুক্ত অধিকাংশই ইউরোপের দেশ (২৮টি)। বাকি দুটি দেশ উত্তর আমেরিকার। ন্যাটো গঠিত হয়েছিল এমন একটি সময় যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। বর্তমানে স্নায়ুযুদ্ধের সেই মাত্রা না থাকলেও প্রতিযোগিতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক অনেকটাই বিপরীতমুখী। পরিস্থিতি সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, জোটের সামরিক কমিটির চেয়ারম্যান রব বাউয়ার সম্প্রতি বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে পশ্চিমা দেশগুলোর জোট ন্যাটো প্রস্তুত। তিনি বলেন, ন্যাটোভুক্ত কোনো একটি দেশে রাশিয়া হামলা চালিয়ে রেডলাইন অতিক্রম করলে আমরা তার প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রস্তুত। আর ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোয় যোগ দেয়া নিয়ে একটি নতুন আলোচনার তৈরি হয়েছে। যদি দেশ দুইটি যোগ দেয় তাহলে-এর সদস্য বৃদ্ধি পাবে এবং অবশ্যই বৃহত্তম এ সামরিক জোট আরও শক্তিশালী হবে। গত বছর থেকেই এ দুই দেশের ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা ওঠে। কিন্তু সেখানে আপত্তি করে তুরস্ক। আর নিয়ম অনুযায়ী, মার্কিন নেতৃত্বাধীন এ জোটে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের সম্মতির প্রয়োজন হয়। তুরস্কের মনোভাব পরিবর্তনে দেশ দুটি জোর প্রচেষ্টা চালায়। কারণ ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হলে ফিনল্যান্ডে ন্যাটোর সদস্য হতে জনআগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাশিয়ার সম্ভ্যাব্য হামলার আশঙ্কায় তারা দ্রুত ন্যাটোভুক্তি হতে চায়। ওদিকে সুইডেনও ন্যাটোতে যোগ দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সময় যত গড়াচ্ছে ততই যুদ্ধের উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেখানে প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, অল্প দিনেই রাশিয়া তার ইউক্রেন মিশন সফল করতে পারবে সেখানে ১ বছর পার হলেও তা হয়নি। উল্টো পশ্চিমাদের দেয়া অস্ত্রে যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্যও পেয়েছে। ইউক্রেনের জন্য সরবরাহকৃত ভারী অস্ত্র বিশেষত ট্যাঙ্ক নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই বিষয়টি আলোচনায় ছিল। যুদ্ধে কি ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে অথবা ইউক্রেনের যুদ্ধ অবস্থানের সুবিধা কতটুকু হতে পারে এসব বিষয় ছিল আলোচনায়। বিগত কয়েক মাস ধরেই যুদ্ধের দিকেই চোখ থাকে সবার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ইউরোপ জ্বলছে। সবদিক থেকেই জ্বলছে। বহুমুখী সমস্যায় রয়েছে দেশগুলো। যুদ্ধ থামার কোনো সম্ভাবনা আছে নাকি তা আরও বাড়বে এসব প্রশ্ন মনে। এখন পর্যন্ত কিয়েভ তিন শতাধিক ট্যাঙ্কের সহায়তা পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছে। যদিও যুদ্ধ বিমানের দাবি নাকচ করেছে বাইডেন। এ ট্যাঙ্ক যুদ্ধের চিত্র পরিবর্তন করতে পারে।
এখন সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের এ সামরিক জোটে যোগ দেয়ার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। কারণ এখন তুরস্ক ফিনল্যান্ডের প্রতি নমনীয় ভাব দেখালেও সুইডেনের প্রতি অনমনীয় মনোভাব ধরে রেখেছে। সাম্প্রতিক সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অবস্থিত তুরস্কের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ ও পবিত্র কোরআন পোড়ানোর মতো জঘন্য একটি ঘটনায় সুইডেনের ন্যাটোয় যোগদানের ব্যাপারে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেন, সুইডেনের আশা করা উচিত হবে না যে, ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে তুরস্ক তাকে সমর্থন দেবে। এ ঘটনা নিশ্চিতভাবে তুরস্কের মনোভাব আরও কঠিন করে তুলেছে। আর তুরস্ক ন্যাটোর সদস্যদেশ হওয়ায় সেই অধিকার রাখে। যদি তুরস্ক ভেটো দেয়, তাহলে শেষমেশ সুইডেনের ন্যাটোয় যোগদান আটকে যেতে পারে। তবে ফিনল্যন্ডের জন্য রাস্তাটা বেশ সহজ হয়ে গেল তুরস্ক সমর্থন দেয়ার ঘোষণায়। এ দুই দেশই রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর ন্যাটোয় যোগ দিতে আবেদন করে। উদ্দেশ্য নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কারণ ন্যাটো তার সদস্যদের রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তুরস্ক সুইডেনের কাছে বেশ কিছু দাবি করেছে, যার মধ্যে কিছু কুর্দির প্রত্যপর্ণ বিষয়ও রয়েছে। ২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টা করে সেনাবাহিনী ও দুষ্কৃতকারী একটি চক্র। সেটি ব্যর্থ হলে চক্রের অনেকে সুইডেনে পালিয়ে যায়। তুরস্কের অভিযোগ হলো নিষিদ্ধ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) অনেক নেতাকর্মী সুইডেনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রয়েছে। গত বছরের জুনে স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় তুরস্কের সঙ্গে দুটি দেশ আলোচনা করে একটি সমঝোতায় আসে। সেখানে তারা এসব সন্দেহভাজন কুর্দি বিদ্রোহীদের বহিষ্কার ও ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে সুইডেনের আদালত বেশ কিছু নির্বাসন মামলা আটকে দিয়েছে।
তারপর আবার সাম্প্রতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি যেখানে স্পষ্টতই তুরস্ক বেঁকে বসেছে। সেপথে এগিয়ে গিয়েও এখন সুইডেনের জন্য রাস্তাটা বেশ কঠিন হয়ে গেল। এখন কি ঘটতে পারে? আলোচনা হতে পারে। সেটা হবেই। কিন্তু সুইডেন যদি সব শর্ত মেনে না নেয়, তাহলে তুরস্ক তার অবস্থান বদলাবে বলে মনে হয় না। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোভুক্তির ব্যাপারে ২৮টি দেশ এরই মধ্যে অনুমোদন দিয়েছে। দ্রুতই হাঙ্গেরির অনুমোদন দেয়ার কথা শোনা গেছে। তাহলে বাদ শুধু তুরস্ক! সেখানে ফিনল্যান্ড একটি ভালো বার্তা পেলেও সুইডেনের বিষয়টি আপাতত ঝুলে গেল। যুদ্ধের মধ্যেই দেশ দুটি ন্যাটোয় যোগ দিতে চেয়েছে এবং যদি সফল হয়, তখন ন্যাটো নিয়ে রাশিয়ার যে অস্বস্তি সেটি আরও বৃদ্ধি পাবে। রাশিয়ার ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পেছনে এটা একটি অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করা হয়। ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করেন যে, ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের কাছে একটা নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, ন্যাটো জোটকে পূর্ব দিকে আর সম্প্রসারণ করা হবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। সে সময় থেকে এ পর্যন্ত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা তার প্রভাব বলয়ের অংশ ছিল এমন অনেক পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশ ন্যাটোর সদস্য হয়েছে। ন্যাটো জোটের এ সম্প্রসারণ যা রাশিয়া মেনে নিতে পারছে না। এ যুদ্ধ হচ্ছে ইউক্রেনের মাটিতেই, যুদ্ধ করছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী; কিন্তু অস্ত্র, অর্থ এবং অন্যান্য জিনিসের জোগান দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর প্রক্সিযুদ্ধ মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গণমাধ্যমের বিভিন্ন বিশ্লেষণে এমনটাই উঠে এসেছে। ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার উত্তেজনা যদি বৃদ্ধি পায়, তা হবে পৃথিবীর জন্য আরও খারাপ পরিস্থিতির। কারণ একটি বৃহৎ সামরিক জোট এবং পৃথিবীর বৃহৎ পরাশক্তির ভেতরের দ্বন্দ্ব মারাত্মক ধ্বংস ডেকে আনবে। তবে আপাতত সুইডেনের জন্য ন্যাটোয় যোগ দেয়ার বিষয়টি তুরস্কের মর্জির ওপর ঝুলে গেছে।