ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কালের কড়চা

উপনির্বাচন, ভোট অরুচিতে জনগণ

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, [email protected]
উপনির্বাচন, ভোট অরুচিতে জনগণ

গত ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ জাতীয় সংসদের ছয়টি আসনে উপনির্বাচন হয়েছে। বিএনপি-দলীয় সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করায় আসনগুলো শূন্য হয়। সংবিধান অনুসারে ৯০ দিনের মধ্যে শূন্য আসন পূর্ণ করার বাধ্যবাধকতায় নির্বাচন কমিশন উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করে। যদিও বর্তমান সংসদের মেয়াদ রয়েছে ১ বছরেরও কম সময়। উল্লেখ্য, গত ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের কথিত অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি মাত্র ৬টি আসনে জয় লাভ করে। সংরক্ষিত একটি মহিলা আসনসহ বিএনপির ৭ জন সংসদ সদস্য সংসদীয় গণতন্ত্রের অংশীদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নানারূপ অভিযোগ এনে বিএনপি সংসদে এবং রাজপথে আন্দোলন করে আসছে। আওয়ামী লীগ টানা তিন টার্ম ক্ষমতায় থেকে দেশ শাসন করে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করলেও রাজনীতিতে ততটা উন্নতি করতে পারেনি বলে রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা সরকারের কাছে বিএনপি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনঢ় অবস্থানে থেকে রাজপথের আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যেই ৭ জন সদস্য পদত্যাগ করেছেন। এটা নিতান্তই তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত এবং দলীয় রাজনীতি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক অগণতান্ত্রিক সরকারের (বিচারালয়ের নির্দেশনা) তকমার অজুহাতে বিএনপির দাবিকে উপেক্ষা করে আসছে। বিএনপিও তাদের এই দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি আজ পর্যন্ত। যে কারণে আন্দোলন অনেকটাই মুখ থুবড়ে গেছে। এদিকে সরকার শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাবে অভাবগ্রস্ত হয়ে গণতন্ত্র ও রাজনীতির পথ হারিয়ে দিকভ্রান্ত অবস্থায় আমলাতন্ত্রের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। রাজনীতির এই সংকটকালে সাধারণ মানুষ রয়েছে সীমাহীন ভোগান্তিতে। ভোগ্যপণ্যের মূল্য দিন দিন ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতি বাণিজ্যিক, সামাজিক নানা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে জনগণের জীবন প্রবাহে যেন নেমে এসেছে অন্তহীন ক্লান্তি। জনগণের নানাবিধ সমস্যা সমাধানের পথ হচ্ছে রাজনীতি। সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই জনগণের মঙ্গলের পথকে প্রশস্ত করতে পারে। যেহেতু সেই রাজনীতিটা এখন নেই তাই পর্বত প্রমাণ সমস্যা জমা হয়ে গেছে। একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অন্যদিকে প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগে বিশ^ অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থায় গোটা মানব সভ্যতাই যেন হুমকির মুখে।

হয়তো এমন অবস্থার উত্তরণ ঘটবে। পৃথিবীতে আবার শান্তি ফিরে আসবে এমন প্রত্যাশা নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনৈতিক সংস্কৃতির তেতো অবস্থার নিরসন কবে হবে সেটি এক বড় প্রশ্ন। রক্তের দামে কেনা এই বাংলাদেশে নির্বাচনকালের ভোট উৎসব কবে সংগতি ফিরে পাবে, সেটি সঠিক বলতে পারছে না কেউ। যে দেশে ভোটের সময় উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করতÑ ভোটাররা ভোটপত্র পছন্দের প্রার্থীকে দেয়ার জন্য সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকত দীর্ঘ সময়। শিশু-কিশোর যুবারা ভোটার না হয়েও উৎসবের আনন্দ উপভোগ করত। ভোটকেন্দ্রের নির্ধারিত দূরত্বে মেলা বসার দৃশ্য আজও চোখে ভেসে ওঠে। কোথায় গেল সেই দিনগুলো? পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যেও ছিল অন্তহীন সম্প্রীতি। রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা সত্ত্বেও স্বভাবসুলভ খাতির প্রণয়ের কোনো ঘাটতি ছিল না। কেন হারিয়ে গেল সেই দিনগুলো? কেনইবা মানুষের ভোটদানে অনীহা, অরুচি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করা খুবই জরুরি। যদিও বলার চেষ্টা করা হচ্ছে সম্প্রতি প্রধান বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় ভোট উৎসবে পরিণত হচ্ছে না। কিংবা জনগণ ভোটকেন্দ্রে ভোটপত্র প্রদানে উৎসাহী হচ্ছে না! এটা কী একমাত্র কারণ? এটা একমাত্র কারণ হিসেবে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করছে সরকারি দলের কেউ কেউ। টকশোতে আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা ভোটকেন্দ্রে ভোটার অনুপস্থিতির জন্য বিএনপিকে দায়ী করে থাকেÑ এমন আত্মঘাতী কথা বলা আওয়ামী লীগার নিজের দলটিকে পচিয়ে ফেলার মিশনে নেমেছে সেটা শীর্ষ নেতৃত্বকে ভেবে দেখা উচিত। এই তো সম্প্রতি সমাপ্ত হওয়া উপনির্বাচনে গড়পড়তা ১৫ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছে। ৮৫ ভাগ ভোটার যখন ভোটদানে বিরত থাকেন, তখন সে ভোটকে নির্বাচন কমিশনার সুষ্ঠু ভোটের মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করছে না। ভোটে দাঙ্গা-হাঙ্গামা না হলেও ভোট সুষ্ঠু অবাধ হয়েছে বলার কোন সুযোগ নেই। কেননা নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে সে নির্বাচনের কোন গুরুত্ব নেই। সে নির্বাচন গণতন্ত্রের পরিচায়ক নয়। যেটি বলতে চাচ্ছি যে, ভোটারদের ভোট দানে নিরুৎসাহ এবং অরুচির মূল কারণ কী? কেন ভোট দেয় না? এ প্রশ্নের সমাধান রাজনীতিকদেরই করতে হবে।

যতদিন না রাজনীতিকরা সঠিক রাজনীতি করবে, ততদিন ভোট উৎসব হবে না। ভোটকে উৎসবে রূপান্তর করতে হলে জনগণের মৌলিক সমস্যার সমাধান জরুরি। সমস্যা জর্জড়িত মানুষের কাছে এখন ভোট অনুষ্ঠান একেবারেই অর্থহীন। মানুষের কাছে এখন বড় বিষয় নিজেকে নিজে কীভাবে উপকার করবে! রাজনীতিকদের দেয়া প্রতিশ্রুতির প্রতি নিম্নতম বিশ^াস আস্থা জনগণের নেই। রাজনীতিকরা এটা বোঝেন কি-না, যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আওয়ামী লীগ বিএনপি, জাতীয় পার্টি, প্রধান তিনটি দলের জনসভায় প্রচুর লোকসমাগম হলেও তার অর্থ এই নয় যে সমাবেশে সবেবেত জনগণ তাদের প্রতি আস্থাশীল। একই ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে সব দলের সমাবেশেই যোগ দেয়। বিশাল জনসমাবেশ দেখে মঞ্চের নেতাদের আনন্দ উচ্ছ্বাস আমরা লক্ষ্য করে থাকি। নেতারা বেশি লোক সমাগম করে সমাবেশের সার্থকতায় আনন্দের ঢেঁকুর তুললেও কার্যত সমাবেশের অধিক লোকের উপস্থিতি কখনও জনপ্রিয়তার মাপকাঠি নয়। এ প্রমাণ অতীতের পতিত সরকারের আমলে দেখা গেছে।

রাজনীতিতে জনগণের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। জনগণ সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও যথেষ্ট সচেতন। এই সাধারণ মানুষের রয়েছে অসাধারণ রাজনৈতিক বিচক্ষণতা। ভালোমন্দ বুঝবার ক্ষমতা যথেষ্টই আছে মানুষের। সাধারণ মানুষ যেটা ভাবে রাজনীতিকরা তার বিপরীতে। ব্যাবসাকেন্দ্রিক রাজনীতি ও গণতন্ত্র মানুষকে কাছে টানতে পারছে না বলেই ভোটের এই অবস্থা। বর্তমান জাতীয় সংসদে বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি ব্যবসাদার। ব্যবসার যুৎসই পুঁজি হিসেবেই তারা রাজনীতিকে বেছে নিয়েছেন। রাজনীতি যে একটা সেবার মাধ্যম সেটা তারা জানে না। অনেক নেতার মুখেই শুনতে পাই বর্তমান সরকার ব্যবসায়িক বান্ধব, ব্যবসায়িক রাজনীতিক ব্যবসায়িক বান্ধব হবে এটাই তো স্বাভাবিক। সচেতন জনগণ বুঝে গেছে ব্যবসায়িক রাজনীতিক দ্বারা তাদের কোনো কল্যাণ হবে না। কাজেই ভোট দিলেই কী আর না দিলেই কী?

বর্তমানে রাজনৈতিক যে রকম পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এমন পরিস্থিতি বহাল থাকলে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাবে নাÑ এটা নিশ্চিতই বলা যায়। ধরুন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো না, বিএনপিসহ আরও অনেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল না, তাতে কী নির্বাচন বন্ধ হবে? সংবিধান অনুসারে নির্বাচন হবে যদি অন্য কিছু না ঘটে! যদি নির্বাচন হয়, তবে ভোটার উপস্থিতি কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়। আবার যদি সব দল অংশগ্রহণ করে তবে তুলনামূলকভাবে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা বাড়বে; কিন্তু আশানুরূপ হবেÑ এমন বিশ^াস করার কারণ নেই। কেননা আত্মপ্রতিষ্ঠার রাজনীতি জনগণের কাঁধে চড়ে বসে আছে। এই রাজনীতি জনগণকে উদ্দীপ্ত করতে পারবে না। যেসব রাজনীতিক মানবিক মূল্যবোধকে ধারণ করে, মনুষত্ব বিকাশে প্রতিশ্রুতিশীল এবং মানবিক উৎকর্ষ সাধনে সক্ষম, তাদের ক্ষেত্রেই সম্ভব জনগণকে ভোটদানে উৎসাহিত করা। এ রকম নেতারা কী মনোনয়ন পাবেন? পাবেন না। কারণ এরকম মানের নেতাদের টাকা নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়েছে, সেখান থেকে আজও রাজনীতিকে পুরোপুরি বেড় করে আনা সম্ভব হয়নি। মানি ও মার্শালম্যান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি সঠিক পথ হারিয়ে ফেলেছে। এ পথ আর কোন দিন ফিরে পাবে কি-না সন্দেহ রয়েছে যথেষ্ট। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে উন্নয়নের বিপ্লব ঘটেছে ঠিক; কিন্তু এ উন্নয়নে রাজনীতিকদের মনুষত্বে কোনো ছোয়া লাগেনি, যে কারণে রাজনীতিকদের থেকে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখন দরকার জাতীয় ঐক্যের নীতি ঠিক করা। সব দলকে একত্রিত হয়ে জাতীয় ঐক্যের নীতি ঠিক করে রাজনীতির পুনসংস্করণ অপরিহার্য। তবেই ভোটে রুচি হবে জনগণের।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত