ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে অসুন

এহসান বিন মুজাহির, সাংবাদিক, কলামিস্ট
সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে অসুন

বাঙালি জাতির গৌরবের মাস ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জন্য গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। ১৯৫২ সালের ৮ ফাল্গুন বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ সেøাগান নিয়ে রাজপথে লড়েছিলেন। মাতৃভাষাকে বাংলাকরণের দাবিতে বায়ান্নর একুশে এ সবুজের গালিচা রক্তে রঙিন হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষাকে বাংলা করার জন্য দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াই করতে হয়েছে দামাল ছেলেদের। রাজপথে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আব্দুস সালাম, রফিক, বরকত, আব্দুল জব্বার, শফিউর রহমান ও রফিক উদ্দিনসহ আরও অজানা অনেক তরুণ প্রাণ বিসর্জন করে শহীদের তালিকায় তাদের শামিল করেন। ’৫২ সালের ৮ ফাল্গুন বাংলা ভাষার জন্য রক্তঝরা জ¦লন্ত সাক্ষী। ’৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর ৩১তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশ ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশে প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি। রক্তঝরা একুশ বাঙালি জাতির গৌরবদীপ্ত একটি দিন। দীর্ঘদিন লড়াইয়ের ফল আজকের ভাষা বাংলা। আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষা আমাদের অহঙ্কার। বাংলা ভাষার জন্য বাঙালি মায়ের সন্তানেরা বুকের টাটকা রক্তের বিনিময়ে লাল হরফে সর্বপ্রথম লিখেছিল বাংলা বর্ণমালা। তাদের প্রাণের মূল্য আমরা কতটুকু শোধ করতে পেরেছি? ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কী ভুলিতে পারি...।’ রক্তে রাঙানো দিন একুশ, না ৮ ফাল্গুন? বিখ্যাত কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা গানটি ঠাঁই পেয়েছে বাংলা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। গানটি গেয়ে আমরা দেশপ্রেমিক শহীদদের স্মৃতিচারণ করি। এ গান পরিবেশন, খালি পায়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন, ভোরে শহীদ মিনারে গমনÑ এমন কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা যেসব কর্মকা- করি এসবের মাধ্যমে ভাষা শহীদের আত্মা কতটুকু প্রশান্তি পায়! ভাষাশহীদদের ত্যাগের মূল্য আমরা কতটুকু শোধ করতে পেরেছি? শিক্ষা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে বাংলাদেশেই বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, স্কুল-কলেজ সর্বত্রই ইংরেজির ছড়াছড়ি। অনেক ক্ষেত্রেই মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিকেই প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলা ভাষা আজ দেশের উচ্চ শিক্ষিতদের ভাষা নয়! বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও বক্তব্যের দ্বারা মাতৃভাষার গুরুত্ব বোঝানোর প্রবণতাও খুব লক্ষণীয়! কিন্তু কাজকর্মে বাংলা ভাষাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি ছোট শিশুদেরও বাংলা ভাষা না শিখিয়ে শুরুতেই ইংরেজি ভাষা (মাম্মি, ডেড, আঙ্কেল, আন্টি) ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। বাঙালি নিজেদের সার্থক হিসেবে পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করেন। অথচ কত বাঙালি বাংলার জন্য প্রাণ দিতেও দ্বিধাবোধ করেননি। অনেকেই মাতৃভাষা বাংলার জন্য শহীদ হয়েছেন। শুধু ভাষা দিবস এলেই আমরা ভাষার গান, ভাষার পক্ষে আলোচনা, শহীদ মিনারে নীরবতা, পুষ্পস্তকসহ রকমারি আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি দিবসটিকে। আফসোস! ভাষার মাসেও কেঁদে ওঠে ভাষাশহীদের আত্মা! শুধু একুশের আনুষ্ঠানিকতা সেরেই কি আমাদের দায়িত্ব শেষ? তা না হলে বছরজুড়ে বাংলা ভাষার প্রতি এত অবহেলা কেন? এসব কি বাংলা ভাষার প্রতি চরম অবজ্ঞা নয়? বাংলা ভাষা মায়ের ভাষা। মাতৃভাষা খোদার সেরা দান। এ ভাষা আমাদের গৌরবের। বাংলা ভাষাকে সর্বক্ষেত্রেই গুরুত্ব দিতে হবে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে খালেদুন বলেন, ‘প্রত্যেক শিক্ষাই তার মাতৃভাষায় হওয়া চাই, কেননা অপরিচিত ভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান ও অর্জন অসম্পূর্ণ শিক্ষারই নামান্তর।’ সংশ্লিষ্টরা বলেন, মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা জাতি হত্যারই নামান্তর।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান ধর্মাবলম্বী। এ দেশের ভাষাও বাংলা। ইসলাম ধর্ম মাতৃভাষার প্রতি যথার্থ গুরুত্ব দিয়ে মায়ের ভাষাকে মর্যাদার উচ্চমানে সমাসীন করেছে। আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুলকে আসমানী কিতাবসহ স্বজাতির ভাষায় পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যেমন হজরত দাউদকে (আ.)-কে তার নিজ ভাষা গ্রিকে যাবুর কিতাব নাজিল করেছেন। হজরত মুসাকে (আ.) তাওরাত হিব্রু ভাষায়, হজরত ঈসাকে (আ.) ইঞ্জিল সুরিয়ানি ভাষায়। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদের (সা.)-এর ওপর পবিত্র কোরআনে কারিম নাজিল করেছেন আরবের ভাষা আরবিতে। মহান আল্লাহতায়ালার অগণিত কুদরতের নিদর্শনগুলোর মধ্যে ভাষা হলো অন্যতম একটি। ইবনে ফারিছ আল লুবাবির মতে, আল্লাহতায়ালা স্বয়ং ভাষা শিখিয়েছেন। তিনি সর্বপ্রথম আমাদের আদি পিতা হজরত আদমকে (আ.) ভাষা শিক্ষা দেন। তা থেকে তার সন্তানেরা ভাষা শিক্ষা লাভ করেছেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআন কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেন, তিনি আদমকে সব বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন (সুরা বাকারাহ : ৩২)। ভাষা সম্পর্কে কোরআন কারিমে আল্লাহ আরও এরশাদ করেনÑ দয়াময় আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন। সৃজন করেছেন মানুষ। শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা (সুরা রাহমান : ১-৪)। কোরআনে অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, তার আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোম-ল ও ভূম-লের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নির্দেশনাবলি রয়েছে (সুরা রুম : ২২)। ‘স্বজাতির ভাষা ছাড়া আমি কোনো রাসুল প্রেরণ করিনি, যাতে সে তাদের কাছে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে পারে।’ (সুরা ইবরাহিম : ৪)। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে কারিমে আরও এরশাদ করেন, আমি প্রত্যেক নবীকে (আ.) তাদের স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছি তাদের সম্প্রদায়ের কাছে, যাতে তারা জাতিকে সুস্পষ্ট ভাষায় বোঝাতে সক্ষম হন (সুরা মারইয়াম : ৯৭)। কোরআনে আরও বর্ণনা করা হয়েছেÑ আমি কোরআনকে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার (সুরা ইউসুফ : ২)। ইসলামি সাহিত্যের দিকপাল মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বলেন, মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা করা জাতি হত্যারই নামান্তর। বাংলা ভাষা সম্পর্কে বিখ্যাত মনীষী আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.) বলেন, বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ মুসলমান এবং দেশের ভাষাও বাংলা। অতএব আলেম সমাজকে বাংলা ভাষা সম্পর্কে বিশাল পা-িত্য অর্জন করতে হবে। বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে খালেদুন বাংলা ভাষা সম্পর্কে বলেন, প্রত্যেক শিক্ষাই তার মাতৃভাষায় হওয়া চাই, কেননা অপরিচিত ভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা দান ও অর্জন অসম্পূর্ণ শিক্ষারই নামান্তর। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও মাতৃভাষায় অনেক গুরুত্ব রয়েছে। তাই আলেম-ওলামাসহ দেশের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য হলো সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষাকে গুরুত্ব প্রদান করা। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসা হোক ভাষার মাসের দৃপ্ত শপথ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত