ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সাগর পাড়ি দিতে মরিয়া রোহিঙ্গারা

মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী, লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী
সাগর পাড়ি দিতে মরিয়া রোহিঙ্গারা

জাতিসংঘ বা তার অঙ্গ সংগঠন ইউএনএইচসির মতে, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা উন্নত জীবন ও চাকরির আশায় প্রায় প্রতিদিনই ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে নৌযাত্রায় থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা এখন বোঝা হিসেবে চিহ্নিত। তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা অনেকাংশে বেড়েছে। বেকারত্ব জীবন থেকে তারাও মুক্তি পেতে চায়। মিয়ানমার সরকার আর কখনও রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত নেবে কি-না সন্দেহ। এই অমানবিক সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ খুব উদ্বিগ্ন এবং ক্ষুব্ধ। এক সময় যারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছিল এখন তারাও সরে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একমাত্র সেই নারী যিনি সাহসের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা চালিয়ে মোকাবিলা করে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের সে দেশে ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের বারবার অনুরোধ জানালে মিয়ানমার সরকার তা উপেক্ষা করছে। প্রায় প্রতিদিনই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মারামারি, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, চুরি ইত্যাদি নিত্যনৈম্যাতিক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে দেখা যায়। ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সাল এই ৮ বছরে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে সাগর পথে রোহিঙ্গাদের নৌযাত্রার হার বেড়েছে বহুগুণ যার কোনো হিসাব নেই। মূলত থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতেই মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা জীবনের রিস্ক নিয়ে সাগরপথে পাড়ি জমাচ্ছেন এবং সাগড়ে অহরহ মারাও যাচ্ছে। এই অমানবিক যাত্রা কোনোভাবেই ঠেকােেনা যাচ্ছে না। এক শ্রেণির দালালদের প্ররোচনায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গারা রাতের অন্ধকারে সাগর পাড়ি দিয়ে থাকে। এ যাত্রায় শুধু ২০২২ সালেই আন্দামান সাগর ও বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গাদের নৌকা ডুবে প্রায় ৪ থেকে ৫০০ রোহিঙ্গা মারা যায়। আর শত শত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও নিখোঁজ সাগরে তাদের হদিস কোনোভাবে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে তাদের মৃত্যু ও নিখোঁজের সংখ্যা সঠিকভাবে বলা দুষ্কর। এ ছাড়া বছরে যাত্রাপথে খাদ্য ও পানীয় জলের অভাবে এবং শারীরিক অসুস্থাতার কারণে আরও ১৮০ থেকে ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে। মিয়ানমার মূলত আন্তর্জাতিক চাপ ও কনভেশনের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলো এখন নীরব ও নির্বিকার। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোনো বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রকে কাছে পাচ্ছে না। অর্থাৎ সমস্যা সমাধান এবং মিয়ানমারে তাদের ফেরতের ব্যাপারে কোনো দেশই কার্যকর পদক্ষেপে অনীহা প্রকাশ করছেন। জাতিসংঘসহ অন্য দেশগুলোর চাপে মানবতার খাতিরে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ নিজেই এখন পর্যুদস্ত। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যাপক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুধু নয়, সক্রিয় ভূমিকা অব্যাহত রাখতে হবে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মাদক পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। এতে বাংলাদেশ হুমকির মধ্যে পরেছে। মাদক, অস্ত্র, মদ, ইয়াবার ঘাঁটি হয়ে পড়ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। এরপর অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত ক্যাম্পগুলোর অভ্যন্তরে বগিরাগতদের আগমন বিপদজ্জনক। মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো বর্তমানে নিরাপদ স্থান। এতে স্থানীয় প্রশাসন বিব্রত অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এরপর কিছু দেশি-বিদেশি এনজিওদের কর্মকা-ে সরকার ক্ষুব্ধ। বিভিন্ন অপরাধ অনেক রোহিঙ্গা আটকও হয়েছে। চীন ও ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ আদৌ রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসন করতে পারবে কি? রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ এখন শুধু বিপদে নয়, নিরাপত্তার ঝুঁকির মধ্যেও রয়েছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের বিরুদ্ধে টিকতে না পেরে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য ছিল এই দেশের মূল জনগণের সঙ্গে মিশে যাওয়া। কিন্তু তা সম্ভব না হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের আশ্রয়শিবির থেকে রোহিঙ্গারা নৌপথে সাগর পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা অনেক গুণ বেড়েছে। শুধু নিরাপত্তা, সুরক্ষা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একটু ভালো দিন ও উন্নত জীবনযাপনের আশায় এ সব রোহিঙ্গা এমন বেপরোয়া হয়ে ঝুঁকি নিচ্ছে, যা একেবারে অমানবিক। তবে তারা এখন বুঝতে পেরেছে যে, মিয়ানমার-বাংলাদেশে তাদের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তারপরও বাংলাদেশ সরকার যেভাবে যতটুকু সম্ভব এই ১০-১২ লাখ রোহিঙ্গাকে বছরের পর পর থাকা-খাওয়া চালিয়ে যাচ্ছে। তবে জাতিসংঘ ও বিশ্ব সমাজকে অনুধাবন করতে হবে এ বোঝার শেষ কোথায়? মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশ আজ নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত শুধু নয়, নিরাপদ জীবনযাপনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের অব্যাহত উদারতায় সে নিজেই আজ রোহিঙ্গাদের নিয়ে অশান্তির কবলে আবর্ত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্ব হওয়ায় গোটা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গরা। রোহিঙ্গাদের জন্য এখন স্থানীয়রা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনিতে অধিক জনসংখ্যার পাশাপাশি এই লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের বিশাল চাপের বোঝা সামলাতে গিয়ে বাংলাদেশকে আজ নানাবিধ সংকটের মুখে পড়তে হচ্ছে। অথচ দেখার কেউ নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত