কাগজে নয়, হৃদয়ে লিখুন

ড. মো. শওকত হোসেন, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মান্না দের কণ্ঠে বাংলায় বহুল শ্রুত একটি গান আছে যাতে বলা হয়েছে : ‘যদি কাগজে লেখো নাম/কাগজ ছিঁড়ে যাবে/পাথরে লেখো নাম/পাথর ক্ষয়ে যাবে/হৃদয়ে লেখো নাম/সে নাম রয়ে যাবে।’ সবাই কিন্তু আমরা নাম রক্ষা করতে চাই। এজন্য হৃদয়ে লিখতে হলেও আমরা অনেকেই রাজি আছি। কিন্তু সমস্যা হলো হৃদয়ে লেখার পদ্ধতি কী? উল্লেখিত সংগীতটির মধ্যে গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার যে পদ্ধতির কথা ইঙ্গিত করেছেন, তা অত্যন্ত রোমান্টিক। বিশেষ এক ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি কাজে লাগতে পারে। তিনি মূলত প্রেমের কথা বলেছেন। প্রেমাস্পদের মনে কীভাবে স্থায়ী চিহ্ন রাখা যায়, সে কথা বলেছেন। অর্থাৎ প্রেমকে চিরদিন ধরে রাখার পদ্ধতির কথা ব্যক্ত করেছেন তিনি। কিন্তু প্রেমের স্থানে কারও মনে যদি জ্ঞান বা কোনো ধারণা স্থায়ীভাবে রাখতে চাই তাহলে উপায় কী? প্রশ্নটি এবার জ্ঞানতাত্ত্বিক সমস্যার ভেতরে নিমজ্জিত হয়েছে। আর তাই সাহিত্যে নয়, এর উত্তর খোঁজা যাক দর্শনতত্ত্বে।

এসব লেখালেখি এবং কাউকে জ্ঞান প্রদান করার বিষয়াদি নিয়ে প্রাচীনকালে যারা ভেবেছেন তাদের মধ্যে সর্বপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক হলেন প্লেটো; আর তিনি যার কাছ থেকে শিখেছিলেন, তিনি হলেন সক্রেটিস। সক্রেটিস কিছু লিখে যাননি, তবে তার ছাত্র প্লেটোর প্রায় সব লেখনীর কেন্দ্রীয় বক্তা হয়েছেনে। সক্রেটিসের দর্শনও তাই বুঝতে হয় প্লেটোর লিখনির মাধ্যমে। তবে মজার ব্যাপার হলো যে, প্লেটোর লেখনীর ওপর ভিত্তি করে লিখন সম্পর্কিত প্রশ্ন তথা হৃদয়ে কীভাবে লিখতে হয়, তা জানতে চাচ্ছি, সেই প্লেটোই লিখনকে সন্দেহ করেছেন। বলেছেন জ্ঞানের জন্য, জ্ঞান শেখানোর জন্য তথা হৃদয়ে ধারনের জন্য লিখন কোনো নিরাপদ মাধ্যম নয়। তবে আমাদের লক্ষ্য অর্জন তথা জ্ঞান হৃদয়ে ধারণ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য এটা কোনো দুঃসংবাদ নয়। কেননা হৃদয়ে কীভাবে কোনো জ্ঞান প্রবেশ করাতে হয় এবং সংরক্ষণ করতে হয় সে উপায়ও প্লেটো দেখিয়েছেন।

লিখন ও তার জ্ঞানতাত্ত্বিক দিকটি নিয়ে প্লেটো যে আলোচনা করেছেন তা প্রধানত পাওয়া যায় তাঁর লিখিত একটি ডায়ালগ গ্রন্থে- যার নাম ‘ফিড্রাস’। এ পর্যায়ে আমরা প্লেটোর ‘ফ্রিডাস’-এ বর্ণিত লিখন সম্পর্কিত তত্ত্বের ওপর আলোকপাত করতে চাই। এই রচনাটিরও কেন্দ্রীয় চরিত্র সক্রেটিস। আর সক্রেটিসের সঙ্গে ডায়ালগ সহযোগী মাত্র একজন, তার নাম ফিড্রাস। ডায়ালগটির সূচনায় ফিড্রাস অনেক খুশি মনে সক্রেটিসের কাছে হাজির হন। সক্রেটিস তার ওই খোশ মেজাজের কারণ জানতে চাইলে ফিড্রাস জানান যে, তিনি এতক্ষণ প্রখ্যাত বাগ্মী লাইসিয়াসের সঙ্গে ছিলেন, যিনি শব্দচয়নের মাধুর্যে সবাইকে মোহিত করে রাখতে পারেন। লাইসিয়াস সেদিন যে বক্তব্য দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেছিলেন তার সেই বক্তৃতার লিখিত কপি ফিড্রাস নিয়ে এসেছেন এবং সক্রেটিসকে সেটা দেখানোর আগ্রহ প্রকাশ করলেন। লিখিত বক্তৃতা নিয়ে একটি নির্জন স্থানে দু’জনে বসলেন। লেখাটি পঠিত হলো। লেখার বিষয়বস্তু হলো প্রেম। প্রেম-সংক্রান্ত একটি বিতর্কমূলক প্রশ্ন নিয়ে লেখাটি প্রস্তুত। লেখাটিতে লাইসিয়াস প্রেম নিয়ে একটি জটিল প্রশ্নের সমাধান তুলে ধরেছেন। সক্রেটিস লেখাটির প্রশংসা করলেন এবং এর পরে ফিড্রাসকে অবাক করে দিয়ে প্রেম বিষয়ে লাইসিয়াসের বক্তব্যের একটা ভিন্ন পাঠ-বিবেচনা বা ইন্টারপিটেশন ক্ষুরধার যুক্তির মাধ্যমে উপস্থাপন করলেন। ফিড্রাস এতে অবাক হলেন। তাঁর অবস্থা তখন ‘শ্যাম রাখি, না কুল রাখি’। তিনি দারুণভাবে লাইসিয়াসের ভক্ত; তাঁর বক্তব্যের সারকথা তিনি ধারণ করেছিলেন নিশ্চিত সত্য জ্ঞানের মতো করে। কিন্তু সক্রেটিসের পাল্টা বক্তব্য শোনার পরে তিনি বিষয়টিতে খেই হারিয়ে ফেললেন। তার এই বিব্রত অবস্থা সক্রেটিস বেশ তাৎপর্যসহকারে উপভোগ করলেন। এবং তাকে আরও অবাক করে দিয়ে তার পূর্বেকার বক্তব্য পাল্টিয়ে আরও ভিন্ন একটি বক্তব্য প্রদান করলেন। এর মাধ্যমে সক্রেটিস ফিড্রাসকে দেখাতে চেষ্টা করলেন যে, একটি লিখিত টেক্সট বা বক্তব্য জ্ঞানের ক্ষেত্রে বা বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে খুব একটা নিরাপদ নয়। কেননা একজন পাঠক বা শ্রোতা তার নানারকম পাঠ-বিবেচনা করে বসতে পারেন।

ফিড্রাস গ্রন্থের আলোচনা প্রেমের বিষয়ে তথা বাক্কলার বিষয়ে বেশ খানিকটা গড়িয়েছে। বিষয়টি এই রচনায় খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয় বিধায় সেটা স্থগিত রেখে লিখন বিষয়েই মূলত সীমাবদ্ধ থাকা যাক। যাইহোক, ডায়ালগের আলোচনা এক পর্যায়ে বেশ জমে ওঠে বাক্কলা (rhetoric) বা বক্তৃতার শিল্পগুণ নিয়ে এবং লেখার মাধ্যমে তা সার্থকভাবে প্রকাশিত হতে পারে কি-না সে বিষয়ে। এ বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করার জন্য প্লেটো পূর্বপুরুষদের বর্ণিত একটি কল্পকাহিনি (myth) বর্ণনা করেন। আর এই কাহিনির সঙ্গে লিখন পদ্ধতির কার্যকারিতা ব্যাখ্যার ইঙ্গিত রয়েছে। কল্পকাহিনির বিবরণ অনুযায়ী প্রাচীনকালে কোনো এক সময় মিশর দেশে একজন অতি ক্ষমতাবান রাজা ছিলেন, যার নাম ‘থামুস’ (thamus)। তার অনেক বুদ্ধি, এমনকি কিছু দ্বৈব-ক্ষমতাও ছিল। গ্রিকরা তাকে ‘অ্যামন’ বলেও বর্ণনা করেছেন। যাইহোক, মিশরের এই মহারাজাকে কোনো কোনো দেবতাও সাহায্য করত এবং তাকে মান্য করে চলত; তার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা ও প্রায়োগিক দক্ষতা দেখে দেবতা ও মানুষ সবাই তার প্রতি গভীর আস্থা রাখত। সেই সময়ে মিশরের নক্রাটিস অঞ্চলে ‘থিউৎ’ (Theuth) নামক এক দেবতা ছিল। এই দেবতা মানবজাতি, বিশেষ করে, মিশরবাসীর জন্য জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন দিকের দিক্ষাদাতা হিসেবে কাজ করতেন- যা মিশরীয় সভ্যতাকে অগ্রায়নে ব্যাপকভাবে সহায়ক হচ্ছিল।

তৎকালীন সময় পর্যন্ত এই দেবতা মিশরবাসীকে জ্যামিতি, পাটিগণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, বিভিন্ন ধরনের ক্রিড়া নৈপুণ্য তথা শিল্পকলারও শিক্ষা দিয়েছেন। মিশরের মহারাজ থামুস তাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। তাকে বেশ প্রশংসা করতেন। তার কাজের সমালোচনাসহ মূল্যায়নও করতেন। একবার এই দক্ষ দেবতা থিউৎ বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে রাজা থামুসের কাছে হাজির হয়ে জানালেন যে, তিনি আরও একটি নতুন বিদ্যা আবিষ্কার করেছেন। এই বিদ্যা হলো লিখন পদ্ধতি। তার এই উদ্ভাবনের কার্যকারিতা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি রাজাকে জানালেন, ‘এই বিজ্ঞান মিশরের মানুষকে জ্ঞানী করে তুলবে। এবং তাদের স্মৃতিশক্তির উন্নতি ঘটাবে। আমি স্মৃতিশক্তি (memory) এবং জ্ঞানের (wisdom) জন্য একটি দাওয়াই বা চিকিৎসা উপকরণ (Pharmakon) প্রস্তুত করেছি।’ একথা শুনে বিজ্ঞ রাজা থামুস বললেন, ‘ওহে সুদক্ষ থিউৎ, কারও থাকে কোনো বিদ্যা বা শিল্পের উদ্ভাবনের ক্ষমতা, আর কারও থাকে সেই উদ্ভাবনের মূল্যায়ন করার ক্ষমতা, এর ব্যবহারিক উপকার-অপকার বিচারের ক্ষমতা। লিখন পদ্ধতির জন্মদাতা হিসেবে তুমি এই প্রক্রিয়াটির প্রতি যে আস্থা অনুভব করছো, এর প্রকৃত পরিণতির ক্ষেত্রে আমার ঠিক উল্টোটাই মনে হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, এই প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে কোনো বিদ্যাকে আত্মায় ধারণ করার দক্ষতাকে কমিয়ে দিয়ে ভুলে যাওয়াকেই প্রণোদনা জোগাবে। জ্ঞানচর্চাকারীরা স্মৃতিশক্তির চর্চা বা ব্যবহারের প্রতি উৎসাহ হারাবে। কারণ লিখন-প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা স্থাপন তাদেরকে এমন কিছু বাহ্যিক চিহ্ন নির্ভরশীলতা শেখাবে যা অন্যের; তাদের একান্ত নিজের আত্মিক শক্তি দিয়ে জ্ঞানচর্চাকারীরা আর কোনো কিছু মনে রাখতে চাইবে না। তুমি যে ফার্মাকন (Potion/Pharmakon) বা উপকরণ উদ্ভাবন করেছ, তা স্মৃতিশক্তি (remembering) চর্চার জন্য সহায়ক নয়, তবে [স্মৃতি থেকে] পুনরুল্লেখ (reminding) করার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।’ [Phaedrus, 275, ন.]

আসলে গ্রিক ভাষায় যাকে ফার্মাকন (Pharmakon) বলা হয় ইংরেজিতে তাকে অনেক সময় ‘Potion’ বলা হয়ে থাকে। এটি হলো ‘ওষুধ’-এর প্রক্রিয়াজাতকরণ, বা যে উপকরণ দাওয়াই হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তবে সব ধরনের ঔষধি উপকরণ কিন্তু সব ক্ষেত্রে একই রকম ফল প্রদান করে না। একই উপকরণ এক ক্ষেত্রে রোগ নিরাময় (remedy) হিসেবে কাজ করে, কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে বিষ (poisonus) হিসেবে কাজ করে। ফার্মাকন শব্দ দ্বারা গ্রিকে এই দুই অর্থই বোঝানো হয়। তাছাড়া এর অন্য একটি অর্থও আছে তা হলো ‘বলির পাঁঠা’ (scapegoat), যা ব্যবহার করে কোনো কিছুর ওপর দায়িত্ব ফেলে নিজে কেটে পরা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে গ্রিক ভাষায় ফার্মাকস (Pharmakos) শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এ পর্যায়ে দেখা যাক্, লিখন পদ্ধতির ক্ষেত্রে এই ফার্মাকন শব্দটি কীভাবে প্রযোজ্য বলে এই গল্পের মধ্য দিয়ে প্লেটো বোঝাতে চেয়েছেন। উপরে উল্লেখিত কাহিনিতে রাজা থামুসের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, লিখন পদ্ধতি ব্যবহার করলে কোনো শিক্ষার্থী তার জানা তথ্য বা বোধকে মনে ধারণ করার চাইতে কাগজে, পাথরে, কম্পিউটারে বা অন্য কোথাও ধারণ করে রাখতে চাইবে। এবং দরকারের সময় ঐখান থেকে আবার সে তার মনে আনতে চেষ্টা করবে। এই প্রক্রিয়ায় জ্ঞানের বিষয় বা অর্জিত জ্ঞান মনের নিজস্ব শক্তি দিয়ে নিজ মনে বা আত্মায় ধারণ করার চেষ্টা না করে এর বাহ্যিক দিক অক্ষর বা চিত্ররূপ কিছু দ্বারা যান্ত্রিকভাবে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা হয়। এতেকরে মনের বাইরের বিষয় দ্বারা জ্ঞানকে রক্ষণাবেক্ষণ করার চেষ্টা করা হয়, নিজ হৃদয়ে বা মনে ধারণ করা হয় না। তাই প্লেটোর মতে, স্মৃতিশক্তিচর্চা বা হৃদয়ে ধারণের ক্ষেত্রে লিখন প্রক্রিয়া ক্ষতিকর (poisonous)। তবে কৃত্রিম উপায়ে কোনো চিহ্ন বা নমুনার মাধ্যমে তা পুনরায় স্মরণে আনা (ecalling) করার ক্ষেত্রে এটি সাহায্য করতে পারে। লিখনকে বলির পাঠা (Pharmakos) হিসেবেও ব্যবহার হতে পারে। যদিও প্লেটো তাঁর ফিড্রাসে এই শব্দটির কথা বলেননি। তবে এ ক্ষেত্রে তা প্রাসঙ্গিক হতে পারে, সেটা হলো লিখন পদ্ধতিতে কিছু বাহ্যিক চিহ্ন প্রতীক ব্যবহার করে জ্ঞানকে মনে রাখার দায় এড়িয়ে যাওয়া বা মনের নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করার গরজটি থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টি ঘটতে পারে। এ প্রক্রিয়াটিও জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর।

যাইহোক, প্রাচীন মিশরের কল্পকাহিনির বর্ণনা, এমনকি প্লেটোর সময়কার বাস্তবতার থেকে মুখ ঘুরিয়ে আমরা যদি সমকালীন পৃথিবীর দিকে তাকাই, তাহলে লিখন পদ্ধতি নিয়ে এত কথা বলার সুযোগ আমাদের হয়তো অনেকটাই ছোট হয়ে আসে। লিখন ছাড়া এখন জ্ঞানচর্চাতো কল্পনাই করা যায় না। কাগজে মোড়া যে কোনো গ্রন্থ, টেক্সট বই, এমনকি নরম মুদ্রণ (soft copy) ইত্যাদির ওপরইতো আমাদের অনেকটাই নির্ভর করতে হয়।

তবে প্রশ্ন উঠতে পারে এই নির্ভরশীলতার মাত্রা কেমন হবে- তা নিয়ে। সবই যদি লিখিত পাওয়া যায়, তাহলে জ্ঞানের ক্ষেত্রে শিক্ষক বা শিক্ষা গুরুদের ভূমিকার মাত্রা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। শিক্ষার্থী নিজে নিজে লিখিত বক্তব্য পড়বে, শিক্ষকও কেবল লিখিত রচনা (text) পড়ে শোনাবেন, শিক্ষক যদি কিছু নিজের থেকে বোঝান সেটাই শিক্ষার্থীরা তরিৎ গতিতে লিখে ফেলবেন, অথবা মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো ডিভাইজ দ্বারা রেকর্ড করে ফেলবেন। ব্যাস, সর্ব জ্ঞানই সংরক্ষিত! তবে কাগজে বা যন্ত্রে, মনে রাখার দায় অনেকটাই গৌণ; আর মনে করার সময় কাগজে অথবা যন্ত্রের কতগুলো চিহ্ন, প্রতীকের ওপর নির্ভর করে ব্যাপারটিকে একেবারেই সহজ করে নেওয়া যায়। মনের ক্ষমতা ব্যবহার করে মনে বা হৃদয়ে লিখনের প্রক্রিয়া এখানে গৌণ হয়ে আসে। হ্রাস পেতে থাকে মানুষের স্মরণশক্তি বা স্মরণ করার যোগ্যতা। আর অন্যদিকে শিক্ষার্থীর মনে কোনো তথ্য বা বোধের স্থায়ী ছাপ তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া বা যোগ্যতা হ্রাস পেতে থাকে। আর প্রকারান্তে সত্যিকারের জ্ঞানী হবার পথ সংকুচিত হয়ে আসে।

লিখন প্রক্রিয়া যে জ্ঞানের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক নয়, তা দেখানোর জন্য প্লেটো তার ফিড্রাস গ্রন্থে লিখনের আরও কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করেন। যেমন, প্লেটোর মতে লিখন জ্ঞানের অবভাস (appearance) উত্থাপন করতে পারে, সতিকার জ্ঞান (reality) নয়। লিখন এক ধরনের চিত্রকর্মের মতো, কোনো চিত্রকর্মকে সত্যিকারের বস্তু বা বিষয় বলে মনে হলেও তা সত্যি নয়, বরং সত্যের প্রতিরূপ (image) মাত্র। লিখনকে প্লেটো বোবা ও এতিম সন্তান বলেও চিহ্নিত করেছেন। লিখিত ভাষার নিকট কোনো কিছু জানতে চাইলে সে কেবল একই কথাই শুনিয়ে যাবে। আবার তার ভুল ব্যাখ্যা দিলেও সে কোনো প্রতি-উত্তর করতে পারবে না। লিখনের লেখক অর্থাৎ তার বাবা তার সাথে উপস্থিত না থাকলে লিখিত বক্তব্য বা text হয়ে পড়ে একান্তই এতিম। তাকে রক্ষা করার জন্য সে উপযুক্ত সাহায্যকারীর অন্বেষণে থাকে। কোনো পাঠ্য বই এর কথাই ধরা যাক্, তাতে কোনো বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হলে ঐ লেখা নিজে নিজেকে সংশোধন করতে পারে না। ভুল না থাকলেও পাঠক তার পাঠ গ্রহণে বা বুঝতে ভুল করতে পারেন। তথ্যের ভুল থাকলে সংশোধন করে পুনমুদ্রণ করা যায়। কিন্তু বুঝতে ভুল হলে তা থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে? একই পাঠ্য বিষয় বা কোনো লিখিত বক্তব্য ভিন্ন ভিন্ন মানুষ আলাদাভাবে বুঝতে পারেন, এমনকি লেখক যা বোঝাতে চাইছেন তা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু বুঝে বসতে পারেন পাঠকদের একাংশ। প্লেটোর এ ধরনের সন্দেহ হাল আমলে নানাভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, লিখনের যদি এতই দোষ বা সীমাবদ্ধতা থাকে, বিশেষকরে, জ্ঞানচর্চার জন্য তা যদি কোনো নির্ভরযোগ্য বিষয় না হয় তাহলে এর সমাধান কী? প্লেটো কিন্তু কেবল লিখন পদ্ধতির সমালোচনা করেই তাঁর বক্তব্য শেষ করেননি। এর সমাধানও দিয়েছেন। তার মতে, জ্ঞান হলো মানবাত্মায় বা হৃদয়ে অপেক্ষাকৃত সুদৃঢ়ভাবে টিকে থাকা কোনো যথার্থ উপলব্ধি, মানুষের স্বকীয় বোধ বা প্রজ্ঞা দ্বারা যা প্রক্রিয়াজাত। আর এ ধরনের জ্ঞান অর্জন করতে হলে কেবল লিখিত বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের প্রজ্ঞার যথার্থ ব্যবহার করে নিজের আত্মিকশক্তিতে তা হৃদয়ে গেঁথে রাখার চেষ্টা করতে হবে। আর এজন্য পাঠ্যবই বা লিখিত বক্তব্যের চাইতে বিশেষভাবে সাহায্যকারী হবেন কোনো জ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান শিক্ষাগুরু। এই প্রজ্ঞাবান শিক্ষাগুরু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ডায়ালগ বা কথোপকথনে অংশগ্রহণ করবেন। কেবল তিনি লেকচার দিবেন না। শিক্ষার্থীদেরও বলতে দিবেন। শিক্ষক শিক্ষার্থী কোনো জ্ঞানের বিষয়ে আলোচনা করবেন যুক্তি দিয়ে, তথ্য ও প্রমাণাদি হবে বিশেষ সহায়ক। তবে সামগ্রিক বিষয়টি অনুধাবনের জন্য তথাকথিত কোনো সৃজনশীল পদ্ধতি নয়, একতরফা লেকচার নয়, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে কোনো কিছু বৌদ্ধিকভাবে অনুভব করতে হবে, নিজ নিজ আত্মায় সেই জ্ঞান গ্রথিত করতে হবে। তাদের আলোচনা হবে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায়। আজকের দিনে অনেকেই মনে করেন যে, প্রগতির প্রক্রিয়া হলো দ্বান্দ্বিক। এই দ্বান্দ্বিক শব্দটি কিন্তু গ্রিক শব্দ ডায়ালগাস (dialogus) থেকে এসেছে, যার ইংরেজি শব্দ হলো ডায়ালগ (dialogue)। সক্রেটিস যে ডায়ালগ পদ্ধতিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মিলিত প্রচেষ্টায় জ্ঞানচর্চা করতেন- প্লেটো মূলত সেই পদ্ধতিই অনুসরণ করতে বলেছেন। এই পদ্ধতিতে জ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রগতি সম্ভব। আর এর প্রধান নিয়ামক হবেন যোগ্য শিক্ষাগুরু, যারা শিক্ষার্থীদের ভাবনাকে উৎসাহিত এবং সমন্বিত করতে পারবেন, যার সাহায্যে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজেদের প্রজ্ঞাকে ব্যবহার করে কেবল কাগজে নয় নিজের হৃদয়ে লিখতে পারবেন। তেমন শিক্ষক খুঁজে পাওয়াই শিক্ষা ও জ্ঞানলাভের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি বিষয়।